অগ্নিকান্ড

১. চকবাজার অগ্নিকান্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই আবারো আরেকটি ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে গেলো ঢাকা শহরে। এপর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২৫ জন। আগুনে পুড়ে, শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছেন আবার কয়েকজন উচু বিল্ডিং থেকে দড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে পরে মারা গেছেন। সব মৃত্যুই বেদনার, সেটা যেভাবেই হোক। তবে ঢাকা শহরে এবং পুরো দেশে সড়ক দূর্ঘটনায় তো মৃত্যুর মিছিল চলছেই।

২. অগ্নিকান্ডের ঘটনা ভয়াবহ দূর্ঘটনার তালিকায় অন্যতম। ছোটবেলায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশী শোনা যেতো পাটকলে অগ্নিকান্ডের কাহিনী। সে সময়ের কোন তথ্য-উপাত্ত অনলাইনে পেলাম না, তবে শুনেছি সেসময়ে পাটকলে সংঘটিত বেশীর ভাগ অগ্নিকান্ড ছিলো নাশকতা। 

এরপর মাঝে মধ্যেই শুনেছি বিভিন্ন বস্তিতে আগুন লাগার খবর। ফি বছর শীতের আগে পরে কোন না কোন বস্তিতে আগুন লাগে। অনেকেই অবশ্য বলে এগুলোও ইচ্ছাকৃতভাবে লাগানো হয়। কোন সময় জায়গা দখল করার জন্য, কখনও আধিপত্য বিস্তারের জন্য।

স্মৃতি’তে অন্যতম বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনা বসুন্ধরা সিটি মলের ঘটনা। ২০০৯ সালের ১৩ই মার্চ ২১ তলা ভবনের ১৩ থেকে ১৮ তলা অগ্নিকান্ডে সম্পূর্ণ ভষ্মিভুত হয়। নিহত হন ৭ জন, আহত অর্ধশতাধিক। সেদিন সামহোয়্যারইন ব্লগের পক্ষ থেকে আমরা পিকনিকে গিয়েছিলাম। সেখানেই প্রথম খবর পাই। ফেরার পথে বাস থেকে এক ঝলক দেখেছিলাম। ২০১৬ সালের ১৬ই আগষ্ট বসুন্ধরা মলের ৬ তলায় আবারো অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিলো। সেবার কেউ নিহত না হলেও ১৯জনকে উদ্ধার করা হয়েছিলো।

দ্বিতীয় ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে ২০১০ সালের ৩রা জুন ঢাকার নিমতলীতে। বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার থেকে সৃষ্ট আগুন আশে-পাশের বিল্ডিং এ রক্ষিত নানা রাসায়নিক দ্রব্যাদির কারণে ভয়াবহ রুপ ধারণ করে। নিহত হন ১১৯ জন, আহত হন শতাধিক।

তৃতীয় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ছিলো ২০১২ সালের ২৪শে নভেম্বর তাজরিন ফ্যাশনে সংঘটিত অগ্নিকান্ড। সে ঘটনায় ১১৭ জন পোষাক শ্রমিক নিহত (১০১ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে এবং ১০ জন উপর থেকে পড়ে) এবং ২ শতাধিক আহত হন।

এরপরের ঘটনা এই তো সেদিন। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারী ২০ তারিখে চকবাজারে এক কারখানা থেকে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডে ৭০ জন নিহত হন, আহত হন অনেকেই। এখানেও আগুন ভয়াবহ রুপ নেয় বিভিন্ন কেমিক্যাল গুদামের কারণে। 

৩. প্রতিবার বড় কোন দূর্ঘটনার পর নানা কিছু আবিস্কার করা হয়। নানা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। তারপর …. তার আর পর নেই। আবারো কোন বড় দূর্ঘটনা ঘটার পর সবাই আবার একটু নড়ে-চড়ে বসে। এবারও তাই হয়েছে। এবারের আবিস্কার বিল্ডিং কোড মানা হয় নাই। আপনিই বলুন ঢাকার কোন বাড়িটা বিল্ডিং কোড মেনে তৈরী হয়েছে ? প্রতিটি বাড়িই দেখা যায় সীমানা দেয়াল থেকে নিয়ম মেনে উঠেছে। ছাদ ঢালাই এর সময়ই সেটা পাশে কয়েক ফুট বড় হয়ে যায়। তারপর আবার বারান্দাগুলি বাড়ানো হয়। ফলে দেখা যায় প্রতিটি বাড়ীই খূব কাছাকাছি। ভিতরে আলো-বাতাস ঢুকে কম, আবার এক বাড়ীর লোকজনের কথা-বার্তা পাশের বাড়ীর লোকজন ঠিকই শুনতে পারে। 

এই অগ্নিকান্ডের পর বলা হচ্ছে প্ল্যান অনুযায়ী এই এফআর টাওয়ার তৈরী হয় নাই। ১৮ তলা পর্যন্ত অনুমোদন ছিলো, তৈরী হয়েছে ২৩ তলা পর্যন্ত। ফায়ার সেফটি বিষয়ে ফায়ার ব্রিগেড গত জানুয়ারীতে চিঠি দিয়েছিলো, সেটি আমলে নেয়া হয়নি। আজ পত্রিকায় দেখলাম ঢাকা শহরে ঝূঁকির মুখে ১১ হাজার দালান। মানে আমরা সবাই আসলে মৃত্যুর খূব কাছাকাছি আছি, যে কোন মূহুর্তেই যে কোন দূর্ঘটনায় চলে যেতে পারে প্রাণ।

৪. এবারের দূর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের লোকজন কাজ করেছে নিরলসভাবে। তাদের কাজ নিয়ে আসলে কিছুই বলার নাই। তবে তাদের ঘটনাস্থলে আসা এবং কাজ করার সময় কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে তথাকথিত ‘উৎসুক জনতা’, টিভিতে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও এবং ষ্তির চিত্র দেথা যাচ্ছিলো কি এক অমোঘ টানে তারা উপরের দিকে তাকিয়ে আছে স্পটে দাড়িয়ে থেকে। এতে যে যাওয়া আসা এবং উদ্ধার তৎপরতায় বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে সে বোধটুকুও মনে হয় কারো ছিলো না। তবে আশে-পাশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তরুন চেষ্টা করেছে এই ‘উৎসুক জনতা’কে কিছুটা দূরে সরিয়ে রেখে সংশ্লিষ্টদের কাজে সূবিধা করে দিতে। একটি ভিডিও’তে দেখা যাচ্ছিলো ফায়ার ব্রিগেডের ল্যাডারবাহি গাড়ি আক্রমন করতে উদ্যত এই ‘উৎসুক জনতা’, পরে কারণ হিসেবে শুনেছিলাম তাদের আসতে দেরী হওয়ায় এই আচরণ। অথচ প্রতিপদে যানজট তারপর লোকজনের অহেতুক দাড়িয়ে থাকার কারণে যে আসতে দেরী হয় হয় সেটা কেউ বুঝে না।

ফায়ার ব্রিগেডের উদ্ধার তৎপরতা এবং আগুন নিয়ন্ত্রনের কার্যক্রম যখন টিভিতে দেখছিলাম তখন মনে হচ্ছিলো ল্যাডারগুলি আরেকটু বড় হলে হয়তো সূবিধা হতো। সেটা নিয়েই গুগল করতে গিয়ে ভুল ভাঙ্গলো। গুগল জানাচ্ছে ল্যাডার কেবল বড় করলেই তো হবে না, গাড়ীর উপর সেটা ষ্টেডি রাখাটা চ্যালেঞ্জ। তাই আমেরিকার ল্যাডারের গড় দৈর্ঘ্য ৭-৮ তলার সমান। সবচেয়ে বড়টি ১৪-১৫ তলা পর্যন্ত যেতে পারে। ইউরোপে আরেকটু বড় ল্যাডার আছে, ২২তলা পর্যন্ত যেতে পারে, কিন্তু সেগুলি অপারেট করার জন্য আরো বড় গাড়ী এবং আরো বড় স্পেস দরকার হয়। সে হিসেবে আমাদের ফায়ার ডিপার্টমেন্টের ল্যাডার ঠিকই আছে। যেটি ঠিক নাই তা হলো আমাদের ম্যানেজমেন্ট আর সততা। বিল্ডিং গুলি যদি নিয়ম মেনে তৈরী হতো তাহলে হয়তো সেখানে ফায়ার এসকেপ থাকতো, যা দিয়ে সহজেই লোকজন নেমে আসতে পারতো। এই বিল্ডিং এ সিড়ি থাকলেও নিরাপত্তার অজুহাতে বিভিন্ন ফ্লোরে বের হওয়ার দরজা ছিলো তালা দেয়া।  আবার পানির জন্য ফায়ার ব্রিগেডের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছিলো বার বার। 

৫. আজ সকালেই ঘুম ভেঙ্গে শুনি গুলশান ১ ডিসিসি মার্কেটের কাঁচাবাজারে আগুন লেগেছিলো। তবে আগুন খূব দ্রুত নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার ব্রিগেডের এক কর্মকর্তা জানালেন সকালে রাস্তা ফাঁকা থাকায় এবং ষ্পটে সেই ‘উৎসুক জনতা’ না থাকায় তারা দ্রুত আসতে পেরেছেন এবং নির্বিঘ্নে কাজ করতে পেরেছেন। ফলে দ্রুতই আগুন নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে পেরেছেন। 

কোন দূর্ঘটনা ঘটার পর আমার আপনার প্রথম কাজ হলো ৯৯৯ নাম্বারে ফোন করে সংশ্লিষ্ট কর্তুপক্ষকে জানানো। তারপর দূর্ঘটনাস্থল ত্যাগ করা। উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করবে প্রশিক্ষিত লোকজন, আমি আপনি করতে গেলে হয়তো হিতে বিপরীতও হতে পারে। তারপর স্পটে অহেতুক দাড়িয়ে থেকে ‘দেখি না কি হয়’ অথবা ‘কতক্ষণে আসে দেখি’ বা ‘শালারা আসে না কেন’ বলে গালাগালি করতে থাকার মানেই হলো আপনি উদ্ধার প্রচেষ্টায় বাধা সুষ্টি করছেন। এম্বুলেন্স / ফায়ার ব্রিগেড অথবা পুলিশের গাড়ীর সাইরেন শুনলে সেই গাড়ীকে আগে যেতে দেয়ার নিয়ম। অথচ এখন দেথা যায় কোন গাড়ীই এইসব গাড়ীকে পথ ছাড়ে না। ফলে তাদের আসতে দেরী হয়। আবার দূর্ঘটনা স্থলে অহেতুক দাড়িয়ে থাকার কারণে স্পিডও তুলতে পারে না গাড়ীগুলো। অথচ কেন দেরী হলো এই কৈফিরত তলব করে আক্রমন করতেও দ্বিধা করি না আমরা। দোষ সবসময় অন্যের, আমি ধোয়া তুলসি পাতা।

বোধোদয় হোক সবার। সুস্থ্য থাকুন, ভাল থাকুন।   

ছবি : Freepik সাইট থেকে নেয়া
Background vector created by macrovector – www.freepik.com

 

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।