অপ্রত্যাশিত সহযোগীতা

আব্বা সরকারী চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন ১৯৯০ সালে। তারপর থেকে নিয়মিতই পেনশন পেয়ে আসছেন। অসুস্থ্য হওয়ার আগে নিজেই ব্যাংকে গিয়ে তুলতেন। অসুস্থ্য হওয়ার পর আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন পেনশন তোলার। যেহেতু সরকারী চাকরি কোনদিন করি নাই, তাই সরকারী নিয়মকানুন ও তেমন একটা জানি না। প্রথম দিকে তাই পেনশন তুলতে নানা রকম সমস্যা হয়েছে। তবে ব্যাংকের কর্মকর্তারা সহযোগীতা করেছিলেন বলে সে সব সমস্যা পার করতে সমর্থ হয়েছিলাম।

প্রথম সমস্যা হলো আব্বা বেঁচে আছেন কিনা সেটা প্রমাণ করা। প্রথম কিছুদিন ব্যাংকে গিয়ে পেনশন বই জমা দিতাম। সিরিয়াল আসলে ফোনে আব্বার সাথে কথা বলিয়ে দিতাম। কিছুদিন পর নতুন কোন কর্মকর্তা এসে ফোন করতে চাইলেন না। বললেন ডাক্তারের কাছ থেকে মেডিকেল সার্টিফিকেট আনতে। মেডিকেল সার্টিফিকেট দিয়ে চললো কিছুদিন। কিছুদিন পর আরেক কর্মকর্তা আসলেন। তিনি কোন ভাবেই মূল পেনশনার ছাড়া পেনশন ছাড় করাবেন না। আব্বা তখনও কোন রকমে নিজের পায়ে দাড়াতে পারতো। তাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দোতলা থেকে ৩জনে মিলে সেই হুইলচেয়ার নিচে নামিয়ে গাড়িতে তুললাম। ব্যাংকে পৌছে আব্বাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে উপররে গিয়ে কর্মকর্তাকে বললাম নিচে আব্বাকে বসিয়ে রেখেছি, কষ্ট করে নিচে নেমে এসে যেন ভেরিফাই করেন। তিনি বিনা আপত্তিতে নিচে নেমে এসে আব্বার সাথে কথা বললেন এবং পেনশন ছাড় করালেন। এর কয়েকমাস পর ব্যাংকে গিয়ে এর ওর কাছ থেকে শুনলাম পেনশন নিয়ে তেলেসমাতি কারবার চলছে। বেশ কিছু কর্মকর্তা নানা অনিয়মের জন্য বদলি হয়েছেন। মূল পেনশনার ছাড়া পেনশন দেয়া হচ্ছে না। ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ করলাম তারা যে কোন সময় বাসায় গিয়ে ভেরিফাই করে আসলে আমাদের জন্য সূবিধা হয়। পরে একজন কর্মকর্তা বাসায় এসে দেখে গেলেন। কথা প্রসঙ্গে তার কাছে জানলাম শুধূমাত্র ব্যাংকের এই শাখা থেকেই প্রায় ২০০ জন মৃত ব্যক্তির পেনশন বছরের পর বছর তুলে নেয়া হয়েছে। পরে তিনি বললেন এরপর থেকে আমি যেন ডাক্তার এর কাছ থেকে মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে ব্যাংক ম্যানেজার কে দিয়ে সাইন করিয়ে পেনশনের জন্য জমা দেই। এরপর থেকে কয়েক বছর এভাবেই চললো। আমি প্রতি মাসে না গিয়ে ৬/৭ মাস পর গিয়ে পেনশন তুলতাম। তুলতাম বললে ভুল হবে, পেনশন আসলে জমা হতো আব্বা আর বোনের জয়েন্ট ব্যাংক একাউন্টে। সাধারণত ১১ মাস পেনশন না তুললে পেনশনার মৃত মনে করে পেনশন বন্ধ হয়ে যেতো। 

মাঝে একবার আব্বার পেনশন বই শেষ হয়ে গেলো। ব্যাংক থেকে হিসাবপত্র নিয়ে যেতে হলো সদরঘাটের ট্রেজারিতে। আমি সাথে করে একটা মেডিকেল সার্টিফিকেটও নিয়ে নিলাম। সেখানেও ভাল সহযোগাতীতা পেয়েছিলাম। কেবল বই দেয়ার আগে একজন সুপারভাইজার বললেন কেরানীকে কিছু বকশিষ দিয়ে যাওয়ার জন্য। 

যাই হোক। বছর খানেক আগে ব্যাংকে গিয়ে জানলাম পেনশন ইএফটি’তে যাচ্ছে। তাই আবার ফর্ম ফিলাপ করে ট্রেজারীতে যেতে হবে। সমস্যা বাধলো এবার নাকি পেনশনার ছাড়া কাজ হবে না। এসময় এক আত্মীয় এগিয়ে আসলেন। তিনিই তার ব্যাংকের লোকজন দিয়ে সব কাজ করে দিলেন। এরপর থেকে প্রতি মাসেই পেনশনের টাকা সয়ংক্রিয়ভাবে  একাউন্টে জমা হতে থাকলো। 

আম্মার মৃত্যু হলো ২০২১ সালের মে মাসে। মাস খানেক পরই আব্বা ব্যাপক অসু্থ হয়ে পড়লেন ইউরিন ইনফেকশনে। প্রায় ১১ দিন হাসপাতালে থেকে বাসায় ফিরলেন আব্বা। তখন কেবল শয্যাশায়ী না, মুখেও কিছু খেতে পারেন না। নাকের ভিতর দিয়ে নল প্রবেশ করিয়ে তরল খাবার দিতে হয় ২ ঘন্টা পর পর। এভাবেই চলছে গত কয়েক মাস ধরে। 

 

গতবছরের শেষ দিন একটা এসএমএস পেলাম যে পেনশনার কে এনআইডি সহ নিকটস্থ হিসাবরক্ষণ অফিসে যেতে হবে লাইফ ভেরিফিকেশনের জন্য। চিন্তা করছিলাম কি করবো। শেষে ফেসবুকের এই গ্রুপে একটা পোষ্ট দিলাম সাহায্য চেয়ে। অনেকেই বললেন আব্বার কাগজপত্র নিয়ে যেন হিসাবরক্ষণ অফিসে যাই এবং কোন অফিসারের সাথে দেখা করে ভিডিও করে আব্বাকে দেখিয়ে দেই। এবাবে অনেকেই নাকি লাইফ ভেরিফিকেশন করতে সক্ষম হয়েছেন। এরমধ্যে এক ভদ্রলোক এনআইডি তথ্য দিতে বললেন মেসেঞ্জারে। মেসেঞ্জারে তথ্য দিতেই তিনি জানালেন পরদিন তিনি ভেরিফিকেশন করে দিবেন। 

পরদিন সকালে নাশতা করে মোবাইল ফোন হাতে নিতেই দেখি এসএমএস চলে আসছে যে লাইফ ভেরিফিকেশন হয়ে গেছে। মেসেঞ্জার খুলতেই দেখি তিনিও মেসেজ দিয়েছেন। আমি তাকে ধন্যবাদ জানালাম। পোষ্টেও জানালাম যে আমার কাজ হয়ে গেছে।

ফেসবুক মারফত এমন অসাধারণ সাহায্য পাবে সেটা কল্পনাতেও ছিলো না। জনাব বেলাল হোসেন সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষকে এভাবে সহযোগীতা করে কি যে উপকার করলেন সেটা আসলে কোন ভাবেই বোঝানো সম্ভব না। আবার শুধূ মুখে বলেও হয়তো ধন্যবাদ জ্ঞাপন সম্পূর্ণ হয় না। 

তারপরও বলবো : ধন্যবাদ জনাব বেলাল হোসেন। আমার এবং আব্বার পক্ষ থেকে শুভ কামনা। 

ফেসবুক গ্রুপ পোষ্টের লিংক এখানে

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।