আবার হাসপাতালে

আব্বার শরীর বেশ কিছুদিন ধরেই ভাল যাচ্ছিলো না। একে তো পুরোপুরি শয্যাশায়ী, তারপর খাওয়া-দাওয়াও সীমিত। খাওয়াতে হয় NG Tube (নাকের ভিতর দিয়ে পাকস্থলী পর্যন্ত ঢোকানো নল) দিয়ে, প্রতি দুই ঘন্টা পর পর। ব্যালান্সড ডায়েট ফর্মূলা এবং ঘরে তৈরী স্যুপ ১০০ এমএল এবং ৫০ এমএল পানি প্রতিবারে। এর বেশী দেয়া যায় না। শরীরে মাংস বলতে কিছু নাই আর। দেখলে মনে হবে কঙ্কালের উপর কেবল চামড়া দিয়ে মোড়ানো। 

এই খাওয়া-দাওয়ার কারণেই হয়তো রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমান বেশ কমে গেছে। আগেও একবার এমন হয়েছিলো। বছর খানেক আগে এক ব্যাগ রক্ত দেয়ার পর বেশ কিছুটা উন্নতি হয়েছিলো। ৩/৪ মাস আগেই ডাক্তার এডভাইস করেছিলেন এক ব্যাগ রক্ত দেয়ার জন্য। আব্বাকে এই অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া বেশ কষ্টকর। আবার হাসপাতালে নেয়া মানেই আরো নানা কিসিমের যন্ত্রনা। যেমন গতবছর হাসপাতালে নেয়ার পর এক ওয়ার্ড বয় পরিস্কার করার নামে ব্লেড ব্যবহার করে ছোট ছোট কিছু ক্ষত তৈরী করেছিলো। তারপর এয়ার ম্যাট্রেস ঠিকমতো ব্যবহার না করায় বেশ কয়েকটা বেড সোরও তৈরী হয়েছিলো। এবারও ভর্তি করার পর এক ওয়ার্ডবয়কে বলে দিয়েছিলাম। ঔষধ এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনতে বাইরে যওয়ার পর ফিরে এসে দেখি নতুন ওয়ার্ড বয় এসে সেই পরিস্কারের কাজটি করে ফেলেছে। ঝামেলা হয় নাই, তবে নোখ কাটতে গিয়ে কিছুটা ক্ষত তৈরী করে ফেলেছে। হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসার পর সেটা চোখে পড়েছে। এরা মহা ঊৎসাহে এই সব পরিস্কারের কাজ করে তারপর বখশিষের জন্য হাত কচলাতে থাকে। 

গত মাসে ব্লাড রিপোর্ট অনুযায়ী আব্বার হিমোগ্লোবিন ছিলো ৮ এর নিচে। ডাক্তার আবারও রক্ত দেয়ার কথা লিখছিলেন এবারও। তবে সাথে দুটো ঔষধ লিখেছিলেন – আয়রন ট্যাবলেট আর নিপোটিন ইঞ্জেকশন। বলেছিলেন হিমোগ্লোবিন কিছুটা বাড়তে পারে, তবে রক্ত দেয়াই হলো বেষ্ট অপশন। 

এই আয়রণ ট্যাবলেটের সবচেয়ে বড় সাইড ইফেক্ট হলো পেট কষা হয়ে যায়। নানু , আম্মা দু’জনকেই দেখেছি এই সমস্যায় ভুগতে। একমাস আয়রণ ট্যাবলেট খাওয়ার পরপরই বাথরুমের প্রব শুরু হলো। আমি রাতে এভোলাক সিরাপ দেই, সকালে ডায়পার বদলের সময় গ্লিসারিন সাপোজিটরি দেই। সামান্য বাথরুম হয়। এদিকে প্রস্রাবও কম হচ্ছিলো মনে হয়। শিরদাড়ার শেষ মাথায় একটা বেড সোর হয়েছিলো মাস দেড়েক আগে। প্রস্রাবে ভিজে যেতো বলে শুকাচ্ছিলোও না। এদিকে প্রস্রাব কম হওয়া, বাথরুম না হওয়াতে এবার সেটা শুকানোও শুরু হয়েছিলো। 

কিন্তু ২/৩ দিন পর পর বাথরুম না হওয়াতে পেট দেখি ফুলে উঠতেছে। ডাক্তারের সাথে দেখা করলাম এপয়েন্টমেন্ট না করেই। উনি অবশ্য খূবই আন্তরিক। ইমার্জেন্সী শুনেই প্রথমেই আমাকে ডাকলেন। শুনে দুটো ঔষধ দিলেন, আয়রণ ট্যাবলেট বন্ধ রাখতে বললেন। সাথে গ্লিসারিন সাপোজিটরি একসাথে ৫টা দিতে বললেন। বললেন এরপরও প্রস্রাব / পায়খানা ক্লিয়ার না হলে ক্যাথেটার লাগাতে হবে, সাথে ফ্লিট এনিমা নামে একটা ফ্লুইড ব্যবহার করতে হবে পেট নরম করার জন্য। দুটোই হাসপাতালে ব্যবহার করা সূবিধা জনক। সাথে বললেন বেশী শক্ত হয়ে গেলে এটাতেও কাজ হবে না, তখন আঙ্গুল দিয়ে বের করতে হবে। নানুর বেলাতেও এমন হয়েছিলো। সমস্যা হলো এই কাজ অনেক ওয়ার্ডবয় / আয়া কিংবা সিস্টার করতে চায় না। 

পরদিন সকলে মনে হলো প্রস্রাব কিছুটা হয়েছে। কিন্তু খাওয়ানোর পর আব্বার অস্থিরত মনে হয় বেড়ে গেলো। মাথা কেবল এপাশ-ওপাশ করতেছে, কিন্তু কোন আওয়াজ করতেছে না। পরে আপা’কে বললাম হাসপাতালে নিয়ে যাই। সে একটু ভয় পাচ্ছিলো বাসায় আর কেউ নাই বলে।

এম্বুলেন্স ডেকে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে। ডাক্তারের এডভাইস তো লেখাই ছিলো। ডিউটি ডাক্তার কাজ শুরু করলেন। ক্যাথেটার লাগানোর পর প্রস্রাব ক্লিয়ার হতে শুরু করলো। এরপর ওয়ার্ডবয়কে দিয়ে উপরে পাঠালেন ফ্লিট এনিমা দেয়ার জন্য। সেটা দেয়ার পর পেট কিছুটা নরম হলো। কিন্তু আধ ঘন্টা পর একজন ওয়ার্ডবয় এসে জানালো ভিতরে শক্ত গোলাকার কিছু একটা পথ আটকে আছে, পেট আর ক্লিয়ার হচ্ছে না। এর জন্য আলাদা লোক আনতে হবে। এর মধ্যে আরো কিছু কথাবার্তা হলো। আমার কিছু করার ছিলো না। লোক এনে শেষতক সেই শক্ত বস্তু অপসারণ করা হলো। 

এই পর্যায়ে এসে মনে হলো হাসপাতালে যখন এসেছি রক্ত একবারে দিয়ে নিয়েই যাই। যদিও ডোনার নাই। এর আগেরবার ভাগ্নের এক বন্ধু রক্ত দিয়েছিলো। ভাগ্নে মাস দেড়েক আগে বিদেশ চলে যাওয়ায় সে রাস্তা আপাত বন্ধ। হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে কথা বলতেই জানালো আব্বার গ্রুপের রক্ত দেয়া যাবে। আব্বাকে এইচডিইই এ ভর্তি করে ফেললাম। এইচডিইউ এ ভর্তি করার সূবিধা হলো ডাক্তার নার্স ২৪ ঘন্টা পাওয়া যায়। 

শেষ পর্যন্ত আব্বাকে রক্ত দিয়ে একরাত রেখে গতকাল (বুধবার) দূপুরে বাসায় ফিরেছি। আব্বা অনেক ভাল ফিল করছে। বিশেষ করে রক্ত দেয়ার পর এখন কথাও বলছে। এর আগে কথা খূব একটা বলতো না, কেবল মাথা নেড়ে হ্যাঁ-না বুঝাতো। 

সব মিলিয়ে খরচ প্রায় ৫০ হাজার টাকা। সিংহভাগ খরচ হাসপাতালের টেষ্ট আর বিভিন্ন আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কেনাকাটায়। ফার্মেসির বিল (ঔষধ + অন্যান্য) ১২ হাজার টাকা। এর মধ্যে এলবুটিন ইঞ্জেকশন এর দাম ৭৬০০ টাকা মাত্র। এইচডিইঊ এর বিল (বেড + টেষ্ট + ডাক্তার + অন্যান্য) ১৭ হাজার টাকা। এইচডিইউ এর বেড ভাড়া ৩৫০০ টাকা। এর বাইরেও আরো প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ আছে। আব্বার ভেইন খূব চিকন বলে সিভি লাইন করতে হয়েছে। এটার কিট কিনে আনতে হয়েছে বাইরে থেকে, দাম ৩০০০ টাকা মাত্র। ক্যাথেটার আর ফ্লিট এনিমার দাম অনুষঙ্গিক সহ ৮০০ টাকার মতো। কিন্তু ক্যাথেটার লাগাতে খরচ হয়েছে ১৫০০ টাকা। আর ফ্লিট এনিমা এপ্লাই + স্পেশাল সার্ভিসের জন্য খরচ করতে হয়েছে মাত্র ৫০০০ হাজার টাকা। তারপরও কাজ হয়েছে, এটাই বড় কথা। 

আব্বার চিকিৎসা হয়তো জোড়াতালি দিয়ে আমরা চালিয়ে নিতে পারছি। কিন্তু প্রতিবার হাসপাতালের বিল দেয়ার পর মনে হয় এই দেশে অসুস্থ হওয়া বড় এক অভিশাপ। 

সুস্থ্য থাকুন নিরন্তর।

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।