ক্যামেরা কথন – ১

প্রথম ক্যামেরার সাথে পরিচয় ১৯৬৮ সালে, আমার বয়স যখন ৪ বছরের মতো। আম্মা নিউমার্কেট থেকে ৪৫ টাকা দিয়ে একটা ফিল্ম ক্যামেরা কিনেছিলেন। পূরো প্লাষ্টিক বডি, তবে ব্র্যান্ড কি ছিলো এখন আর কারোই মনে নেই। অনেকে হয়তো ৪৫ টাকা দাম শুনে হাসছেন, সেই আমলে কিন্তু ঢাকা চিটাগাং প্লেন ফেয়ারও ছিল ৪৫ টাকা। এই ক্যামেরারটার স্মৃতি আবছা মনে পড়ে এখনও। বাকি সব তথ্য আব্বা-আম্মার কাছে শোনা। তবে সেই ক্যামেরাটার আয়ূ খূব বেশী দিন ছিলো না। আমি নিজে এই ক্যামেরায় ছবি তোলার সূযোগ খুব একটা পাই নাই। সব ‘বড়’রাই ছবি তুলতো।একেতো প্লাষ্টিক বডি তারপর আমি সহ অন্যান্য পোলাপানের অত্যাটারে সেটা এক সময় ভেঙ্গে যায়। এরপরের ক্যামেরাটা ছিলো অলিম্পাস। এটা আব্বা লন্ডন থেকে এনেছিলেন ১৯৬৯ সালে এটা অনেকদিন টিকেছিলো। কিন্তু একসময় সেটা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তারপরও সেটা ছিলো, আমার খেলনা হিসেবে। আমি লেন্সটা খূলে রেখেছিলাম। কিন্তু কোন একবার বাসা বদলের সময় সেটাও হারিয়ে যায়। এরপর অনেকদিন ক্যামেরার সাথে যোগাযোগ নেই। অন্যের ক্যামেরা পেলে এক-আধটা স্ন্যাপ তুলে মনের সাধটা মিটাতাম।

এরপর দীর্ঘ বিরতি। ক্যামেরার অভাবে শখটা অবচেতন মনে ঠাঁই করে নিয়েছিলো। এখানে বলে রাখা ভাল এই দুই ক্যামেরা দিয়ে বা অন্যের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলেছি অনেক, তবে সেটাকে ঠিক ফটোগ্রাফী বলা চলে না। জন্মদিন, বিয়ে-শাদী বা পিকনিকে যা তুলেছি সবই আত্মীয়-স্বজন / বন্ধুদের ছবি, স্মৃতি ধরে রাখা আরকি। তখন পড়ি স্কুলে, ক্লাস টেনে ওঠার পর স্কুল থেকে পিকনিকে গেলাম। বন্ধু খোরশেদ আলম বাবুল নিয়ে গেল ইয়াসিকা ইলেক্ট্রো ৩৫ ক্যামেরা। সারাদিন আমি আর বাবুল মিলে ছবি তুললাম অনেক। পরদিন বাবুল দিল চরম দুঃসংবাদ। ভূট্ট ভাই নামের জনৈক প্রতিবেশী নাকি ফিল্ম লোড করে দিয়েছিলো উল্টা করে। প্রসেস করার পর দেখা গেল সবই ফাঁকা। কেবল ফটোগ্রাফীটাই যে জলে গেল তাই না, দূর্লভ কিছু ছবি থেকেও আমরা বঞ্চিত হলাম। ভূট্টো ভাই কে এরজন কম কথা শুনতে হয় নাই, বেচারা এরপর আর কোনদিনই আমার বা বাবুলের সামনে ক্যামেরার দিকে হাত বাড়ানোর সাহস পায় নাই। যাই হোক বাবুলের সেই ক্যামেরা দিয়ে আরো অনেক ছবি তোলা হয়েছে। কিন্তু অন্যের ক্যামেরা দিয়ে কি আর নিজের সাধ মেটানো সম্ভব !!!

১৯৮৯ সালে গেলাম সুইডেন। মাথার মধ্যে দুইটা চিন্তা। প্রথমত একটা ডিজিটাল রেডিও কিনতে হবে আর দ্বিতীয় চিন্তা ফেরার সময় যে করেই হোক একটা ক্যামেরা নিয়ে যাব। রেডিও’টা প্রথমে ছিলো কারণ তখন আমি রীতিমতো আন্তর্জাতিক বেতার শ্রোতা। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আব্বা একটা টু ইন ওয়ান কিনেছিলো। ক্লাস টেনে পড়ার সময় থেকে সেটা ছিল আমার কব্জায়। কারণ সেটার ক্যাসেট প্লেয়ার অংশটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। রাত নাই দিন নাই ফাঁক পেলেই আমি রেডিও’র নব ঘুড়িয়ে নানা রকম রেডিও ষ্টেশন আবিস্কার করি। রেডিও শুনতে শুনতেই জানলাম ডিজিটাল রেডিও’র কথা। সাথে এমেচার রেডিওর কথা। ঢাকায় তখনও ডিজিটাল রেডিও দেখি নাই। তাই সুইডেনে যাওয়ার আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম কি রেডিও কিনবো।

রেডিও প্রসঙ্গে নাহয় আরেকদিন কথা বলবো। আজ শুধূ ক্যামেরার কথাই বলি। সুইডেনে আমি গিয়েছিলাম খূব অল্প সময়ের জন্য। তাই কোন কাজ না থাকলে বের হতাম উইন্ডো শপিং করতে। এটার যে কি মজা সেটা যে করে সেই জানে। তবে খারাপ দিকও আছে – কিনতে না পারার দূঃখ। তবে আমার একটা বাজে অভ্যাস আছে – পকেটে টাকা থাকলে সেটা কচকচ করে আর আমি কিছু না কিছু কিনেফেলি। আর কিছু না হোক নিদেন পক্ষে চকলেট। আর কয়েক বছরের মধ্যেই আমার বয়স অর্ধ শতক পূরো হবে, আমি এখনও সমান তালে চকলেট খাই। হাবি-জাবি জিনিস কিনে অনেক টাকা নষ্ট করেছি সুইডেনে। একদিন এক পোষ্ট অফিসের পাশেই দেখি একটা ক্যামেরার দোকান। ঢুকলাম … অনেক ক্যামেরা। এসএলআর ক্যামেরাও ছিলো। কিন্তু সেসব সম্পর্কে কোন ধারনাই নাই সেসময়। আর দাম তো সাথেই লেখাই আছে, আমার সাহসে কুলায় না। আর মাথায় চিন্তা রেডিও কিনতে হবে। আমি পর পর কয়েকদিন গেলাম সেই দোকানে। কোন কথা বলি না, খালি দেখি। মাঝে মধ্যে লিফলেট বা ব্রসিউর উল্টে-পাল্টে দেখি। যদিও সুইডিশ ভাষা বুঝি না, টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন গুলো কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। এর মধ্যে সেলসগার্ল গুলো মনে হয় মার্ক করেছে আমাকে। ঢোকার সময় কেউ না কেউ হাসি দিয়ে স্বাগত জানায়। আমি কিছু বলি না দেখে ওরাও চুপ থাকে। একদিন একটা ক্যামেরা দেখে মনে ধরলো। ব্র্যান্ডটা মনে নেই, এখনকার সুপার জুম টাইপের। লিফলেট পড়ে কি যেন একটা বুঝতে পারছিলাম না। এদিক সেদিক তাকাতেই এক সেলসগার্ল এসে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলো সুইডিশে। আমি ইংরেজীতে ব্যাপারটা জানতে চাইলাম। সে আমাকে বুঝিয়ে দিলো এবং শেষে কামেরাটা হাতে দিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখতে বললো। আমি ইতস্তত করে বললাম এটা আমি নিবো কিনা এখনও জানি না। সে হেসে জবাব দিলো “দ্যাটস নট এ প্রবলেম”। আমি দেখা শুরু করলাম। এরপর সে নিজেই আমাকে আরো কয়েকটা মডেল দেখাল। এদিকে আমার পকেটের টাকা কচকচ করা শুরু করেছে। দেখছি, এরাও দেখাচ্ছে, তেমন কোন কাষ্টমার নেই আমি ছাড়া (যদিও আমি কাষ্টমার কিনা কেউ ই জানে না)। এমন সময় সবচেয়ে কম বয়সী এবং সুন্দরীতম সেলসগার্ল হাতে একটা ক্যামেরা নিয়ে ভূবন ভোলানো একটা হাসি দিয়ে বললো “এটা দেখ, নতুন এসেছে। খূবই ভাল। আমি নিজে একটা নিয়েছি।” আমার কানে কে যেন ফিস ফিস করে বললো “ব্যাটা বাঙ্গাল আর কত দেখবি। কিনে ফেল। দেখছিস না, কি সুন্দর হাসি দিল। ওটা বোনাস।” জানলাম এটা অটো ফোকাস এবং সাথে আউট অফ ফোকাস ক্যামেরা। আমার মাথা তো পূরাই চক্কর দিল। বলে কি এসব। মেয়েটা তখন বুঝিয়ে দিলো ফোকাসটা অটো হবে, একই সাথে সাবজেক্টের পিছন দিকটা আউট অফ ফোকাস হয়ে যাবে। এরপর সে এক্সকিউজ মি বলে পিছনের দিকে চলে গেল, ফিরে এলো বেশ কিছু ছবি হাতে। তার নিজের ক্যামেরায় তোলা। দেখলাম ভালই তো। ক্যামেরার দাম ৮০০ ক্রাউন, সাথে এক রোল ফিল্ম ফ্রি আর ৩ রোল ফিল্ম প্রসেসিং এবং 4R ডাবল প্রিণ্ট আউট পূরাই ফ্রি। এদিকে টাকার কচকচানি মারাত্মক পর্যায়ে পৌছে গেছে। মেয়েটা আরেকটা ভূবন ভোলানো হাসি দিয়ে জানতে চাইলো “পছন্দ হয় ?” আমি এবার পূরাই কাইত। তবে ক্যামেরা পছন্দ হলো নাকি হাসিটা, জানি না – কিনেই ফেললাম শেষ পর্যন্ত – মিনোল্টা।

বাসায় এসে দেখালাম। চাচাত ভাই দাম শুনে একটা বকা দিলো। বললো মিনোল্টা নামের কারনেই নাকি এই দাম। বাজারে এর থেকে আরো অনেক ফিচার ওয়ালা চাইনিজ ক্যামেরা আছে, দাম ৫০০ ক্রাউনের মধ্যে। আমি একটু দমে গেলাম। মনটা একটু খঁত খূঁত করতে থাকলো।যদিও আমার ৩০ দিনের মানি ব্যাক গ্যারান্টি ছিলো। ভাবলাম ফিল্মটা শেষ করে ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে আসবো।

রাত্রে স্বপ্নে দেখলাম সেই সুন্দরী আবার সেই ভূবন ভোলানো হাসি দিচ্ছে আর আমি তার ছবি তুলছি। এরপর বেশ অনেকবার তার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে ফিল্ম কেনা, প্রসেসিং আর প্রিন্ট আউট বের করার সময়। প্রতিবারই সেই হাসি, টুকটাক কথাবার্তা। অথচ তার ছবি তুলতেও চাইনি – কেন জানি না॥

আমার আর ক্যামেরাটা ফেরত দেয়া হয়নি।

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।

2 Comments

  • আজ সকালে হঠাৎ করে দ্বিতীয় খণ্ডটা পড়লাম আগে। তারপর প্রথম খণ্ডে এলাম। ঝরঝরে লেখা। পড়ে মজা পাওয়া যায়। তবে সাথে তখনকার তোলা ছবি থাকলে মজা বাড়ত। আর সেই সেলসগার্লের ছবি!( ছবিই তোলেন নি তার। কি বিপদ!) চলুক । থামবেন না।

  • না, সেই সেলস গার্লের কোন ছবি আর তোলা হয়নি। তবে আমি যেখানে কাজ করতাম (পোষ্ট অফিস) সেখানে কর্মরতদের ছবি তুলেছিলাম। আর ছিলো নাচের স্কুলের কিছু ছবি। সামনের কোন লেখায় হয়তো দিবো। ধন্যবাদ পড়ার জন্য এবং কমেন্ট করার জন্য ভাল থাকবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *