নামের বিড়ম্বনা

আমার পুরো নাম রিফাত জামিল ইউসুফজাই। এর মধ্যে রিফাত শব্দটি নিয়ে আমাকে মাঝে মধ্যে বিকট সব ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। শুনুন তার কয়েকটা –

সালটা ১৯৮০। পড়ি তখন উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে ক্লাস টেন এ। মিসেস জায়েদ এর জায়গায় আমাদের নতুন ইংরেজী শিক্ষিকা হয়ে এসেছেন রাখী ভদ্র। একদিন ফার্ষ্ট পিরিয়ডের সময় রোল কল করছেন তিনি। আমার রোল ডাকতেই “ইয়েস ম্যাম” বলে হাত তুলে উপস্থিতি জানান দিলাম। ম্যাম রোলকল থামিয়ে একটু হেসে সামনে বসা তানভীন রহমান কে বললেন ” আচ্ছা ওর নামটা মেয়েদের না ?” আর যায় কোথায়! ক্লাসের ৩৫ জনের মধ্যে প্রায় ১৪/১৫ টা ছিল মেয়ে। সবকটার হাহা-হিহি শুরু হয়ে গেছে। এদিকে আমার তো তখন রীতিমতো প্রেষ্টিজ নিয়ে টানাটানি। তানভীনও দেখলাম কোনরকমে হাসি চেপে ম্যামকে সমর্থন জানাচ্ছে। নিজ প্রেষ্টিজ রক্ষার্থে আমি বললাম “ম্যাম, আমি এখন পর্যন্ত রিফাত নামের কোন মেয়ে দেখি নাই।” উনিও হেসে বললেন “রিফাত নামের আরেকটা ছেলে দেখাও দেখি।” আমার তো তখন খাবি খাওয়ার দশা। আরে আছে তো। আবিস্কারের আনন্দে আমি বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে সবিনয়ে বললাম “জ্বি, আমার ছোট ভাই এর নাম রিফাত সিলভী ইউসুফজাই।” ম্যাম কি একটু থমকালেন !!! মূহুর্ত মাত্র, চোখ পাকিয়ে বললেন “এই পাজি! তোমার আব্বা কি তোমার ছোট ভাই এর নামের সাথে মিলিয়ে তোমার নাম রেখেছে নাকি ?” পূরো ক্লাস ততোক্ষণে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে। পরে জানলাম ম্যাম এর এক বান্ধবী আছে রিফাত নামে। কি আর করা! রণে ভঙ্গ দিতেই হলো।

এরপর ১৯৮১ সালের কথা। এস. এস. সি. পরীক্ষা দিব। জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা। নাকে-মূখে পড়ছি। পরীক্ষার ২/৩ দিন আগে স্কুল থেকে খবর পাঠাল এডমিট কার্ড নেয়ার জন্য। আম্মা আমার এই স্কুলে যায় নাই কখনও। আমার স্কুল জীবনও প্রায় শেষ। আমি আম্মাকে নিয়ে স্কুলে গেলাম। গেট দিয়ে ঢুকছি, সামাদ মামু (গেট কিপার) বললেন “যান তাড়াতাড়ি। আপনার জন্য সবাই ওয়েট করতেসে।” মূখে মৃদু হাসি, দেখে ভাবলাম দুই দিন বাদে পরীক্ষা, সামাদ মামু হয়তো অভয় দিতে চাইছে। তখন কি আর জানি ………. । সামনে তাকিয়ে দেখি প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের সামনে ছোটখাট একটা জটলা। সেখানে প্রিন্সিপাল সাহা স্যার, বাংলা মিডিয়ামের হেডমিষ্ট্রেস মিসেস লুতফা চৌধূরী, কেমিষ্ট্রি’র টিচার তপন পাল স্যার আর আরেক ইংরেজী টিচার মন্ডল স্যার সহ আমাদের ক্লাসের তানভীন, তুলি, রুচিরা, সালাম, কায়সার আরো কে কে যেন। সাহা স্যার আমাকে দূর থেকে দেখেই হাত নেড়ে বললেন “তাড়াতাড়ি আস। তোমার তো একটা ঘাপলা হয়ে গেছে।” ঘাপলা !!! আমার দুইদিন বাদে পরীক্ষা, আর এখন বলে কিনা ঘাপলা। ত্রস্তপায়ে কাছে গেলাম। আম্মাও মনে হয় একটু ভড়কে গেছে। হাজার হলেও তার জ্যেষ্ঠপুত্রের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা। কিন্তু একি! সবার মূখ হাসি হাসি কেন ? ছাত্রের পরীক্ষার দুইদিন আগে ঘাপলা ধরা পড়লো আর তারা কিনা হাসছে। ‘রোম যখন পুড়িতেছিল নীরো তখন বাশি বাজাইতেছিলেন’ টাইপের ব্যপার মনে হচ্ছে। মনের দুঃখ পেটে চালান করে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম “স্যার, কি হয়েছে ?” স্যার উল্টা আমাকে প্রশ্ন করলেন “এই তোমার নামটা কে রেখেছিল ?” আমার দুইদিন বাদে পরীক্ষা, আমি কাতর কন্ঠে বললাম “কেন স্যার ?” স্যার হেসে বললেন “তোমার রোল নাম্বারের আগে তো একটা ‘ম’ বসে গেছে।”আমি চোখ গোল গোল করে বললাম “স্যার,’ম’ বসে গেছে মানে ?” শ্রদ্ধেয় শিক্ষক পেপসোডেন্ট মার্কা একটা হাসি দিয়ে বললেন “বুঝলা না। ‘ম’ মানে মহিলা।” ‘ম’ মানে মহিলা – তার মানে ??? আয় হায়!!! হে ধরণী তুমি দ্বিধা হও। দুই দিন বাদে আমার পরীক্ষা, শেষকালে এও ছিল কপালে। এরমধ্যে লুতফা ম্যাডাম আম্মাকে দেখি আশ্বস্ত করছেন “চিন্তার কিছু নাই, আমরা বেশীর ভাগটাই ঠিক করে ফেলেছি। কালকে রিফাতের আব্বাকে একটু বোর্ড অফিসে পাঠাবেন এডমিট কার্ডটা দিয়ে। চেয়ারম্যান সাহেবকে জানানো হয়েছে। উনি ‘ম’ টা কেটে ওখানে একটা সিগনেচার করে দিবেন।” তারপর আমার হতে তুলে দেয়া হলো সেই ঐতিহাসিক প্রবেশপত্র। এদিকে পোলাপার সব হাসাহাসি করতেছে। ‘বেশির ভাগ ঠিক’ করা বিষয়ে যা জানলাম তাতে ঘাড়ের চুল সব খাড়া হয়ে গেল। এই এক ‘ম’ এর সুবাদে আমার সিট গিয়ে পড়েছিল কামরুন্নেসা গার্লস স্কুলে। বিমল স্যার আর তপন পাল স্যার মিলে সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে সেখান থেকে সিট সেগুন বাগিচা বয়েজ স্কুলে নিয়ে এসেছেন। সেখানেও আরেক ঘাপলা। তারা আগেই সিট এরেঞ্জমেন্ট সেরে ফেলেছিলেন। ফলে আমাকে দেয়া হচ্ছিলো একা একটা রুমে। আমার স্কুলের দুই শিক্ষক রীতিমতো ফাইট করে আমাকে সবার সাথে বসার ব্যবস্থা করেছিলেন। সব শুনে ফটকা সালামের মন্তব্য ছিল এই রকম “কেউ সুযোগ পায় আর কেউবা পেয়ে হারায়। এতো এতো মেয়ের মাঝখানে রাজার মতো বসে পরীক্ষা দেয়ার দূর্লভ সূযোগ তুই ব্যাটা এমনি হারাইলি।”

পরের দিন আব্বা যখন আমার এডমিট কার্ড নিয়ে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করেন, তখন তিনি নাকি বলেছিলেন যে জীবনে অনেক ভূলত্রুটি সংশোধন করেছেন, কিন্তু লিঙ্গান্তরের ত্রুটি সংশোধনের ঘটনা এই প্রথম।

প্রথম পরীক্ষার দিন আরেক কাহিনী। সেগুন বাগিচা স্কুলের যিনিই রুমে আসছেন তিনিই মাথায় একটু হাত বুলিয়ে আদর করে বলছেন আচ্ছা ! তুমিই তাহলে সেই ছেলে। জবাবে একটু হাসি তো দিতেই হয়। কি আর করা।

আমার নাম নিয়ে সর্বশেষ যে ঘাপলাটা হলো সেটাকে জাতীয় দূর্ঘটনা বলা য়েতে পারে। সালটা ঠিক মনে নাই, মনে হয় ১৯৯১। জীবনে প্রথম ভোটার হয়েছি আর প্রথমবার ভোট দিতে যাব। থাকি তখন মোহাম্মদপুর বাবর রোডে। ভোটের দিন গোসল করে, ভাল কাপড় পরে রীতিমতো নওশা সেজে গেলাম ভোট কেন্দ্রে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যে ভোটার স্লিপ দেয়া হয়েছিল তার দু’একটা পকেটে। বেশ গাম্ভীর্য নিয়ে ঢুকলাম ভোট কেন্দ্রে। একটু দাড়িয়ে আড় চোখে দেখে বুঝতে চাইলাম কেমনে কী। বিসমিল্লাহ বলে একটা লাইনের পিছনে গিয়ে দাড়ালাম। লাইন আগায়, সাথে আমিও। আর আরচোখে দেখি কে কি করে। আর আমিও সেরকম করার চেষ্টা করি, যাতে কেউ ধরতে না পারে আমি আসলে নাদান ভোটার, জীবনেও ভোট দেই নাই। সামনের প্রায় সমবয়েসী একটা ছেলে দেখি পকেট থেকে সিগারেট বের করে ফস করে ধরিয়ে আয়েসী ভঙ্গতে টানছে। আমিও ওর দেখাদেখি লাইন থেকে একটু বেরিয়ে এসে ষ্টাইল করে পকেটে হাত ঢুকাই। হাত ঢুকিয়েই ফ্রিজ হয়ে গেলাম। হায়! হায়!! আমিতো ধূমপানই করি না।।। কি আর করা। অবশেষে সেই কাংখিত সময়টি এলো। জীবনে প্রথম সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছি। পোলিং অফিসার ভোটার নম্বর জিজ্ঞাসা করলেন। বললাম। এরপর নাম। বাধলো বিপত্তি। নাম-ঠিকানা কোনটাই মেলে না। পোলিং অফিসার কে ভোটার স্লিপ দেখালাম একটা। দেখে বললেন “ভুল হয়েছে কোথাও। সারাদিন পড়ে আছে, দেখেন ভূলটা বের করতে পারেন কিনা।” আমার কান দিয়ে তখন লু হাওয়া বইছে। বের হয়ে এসে যে কয়টা ক্যাম্প পেলাম সব কয়টা তন্নতন্ন করে খুজলাম। নাম্বারের সাথে নাম মিলেনা। আর কোন লিষ্টেই আমার নাম নাই। ক্যাম্পের লোকজনও হতভম্ব। কারণ স্লিপ তো ওরাই লিখেছে। কোথা থেকে আসলো এগুলো। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বাসায় ফিরছি। এক পাড়াতো ছোট ভাই ডাক দিলো। ওকে বললাম সব কথা। ও নিয়ে গেল পাশের এক ক্যাম্পে। লিষ্টটা চেয়ে নিয়ে লাইন বাই লাইন দেখা শুরু করলো। আমিও দেখছি। হঠাত করেই চোখ আটকে গেলো একটা নামে – নাজমা ইউসুফজাই। সবর্নাশ, ছোট চাচীর নাম ছেলেদের লিষ্টে কেন। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। তাহলে কি আমার নাম …. । আর ভাবতে পারলাম না। পাড়াত ভাইকে বললাম মেয়েদের লিষ্ট বের করতে। আগের সেই নাম্বার মিলিয়ে জায়গামতো যেতেই দেখি নিজের নামটা জ্বলজ্বল করতেছে। ক্যাম্প থেকে বের হয়ে এলাম। ক্যাম্পে তখন রীতিমতো হাসাহাসি চলতেছে।

আমি আবার গুটি গুটি পায়ে ভোট কেন্দ্রে হাজির হলাম। গেটের পাশেই পুলিশ-আনসাররা জটলা করে আছে। ওদেরকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম প্রিসাইডিং অফিসারের কথা। এক বয়স্ক কনষ্টেবল দূরের এক জটলার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালেন। আমি তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে সালাম দিয়ে বললাম “আমি প্রিসাইডিং অফিসারের সাথে একটু কথা বলতে চাই।” সাদা সার্ট পড়া এক ভদ্রলোক বললেন “বলেন কি বলতে চান।” বুঝলাম ইনিই তিনি। অগত্যা আমি তাকে সংক্ষেপে আমার কাহিনী বর্ণনা করলাম। আশেপাশের সাংবাদিক ভাইরা তখন প্রবল উৎসাহে মাইক্রোফোন এগিয়ে ধরেছে। আর আমার প্রিসাইডিং অফিসার সাহেব দ্রুত বেগে মাথা নাড়তে নাড়তে বলছেন “ভাই আমাকে মাফ করবেন, আমার এই মূহুর্তে কিছুই করার নাই।” ওনাকে থামিয়ে দিয়ে এক স্যুট পড়া ভদ্রলোক বললেন “আপনি ভুল বলতেছেন। নাম-ঠিকানা যদি ঠিক থাকে তাহলে উনি অবশ্যই ভোট দিতে পারবেন।” জানলাম মানুষরূপী এই দেবদূত নির্বাচন কমিশন থেকে আগত। তারই পরামর্শ মতো প্রিসাইডিং অফিসার আমাকে একটা মহিলা বুথে নিয়ে গিয়ে বললেন “এই ভদ্রলোকের নামটা ভুলক্রমে মহিলাদের লিষ্টে চলে এসেছে। পোলিং এজেন্টদের কারও যদি আপত্তি না থাকে তবে উনি ভোট দিতে পারবেন।” আর এই কথাগুলো বলার সময় ওনার মূখে ছিল মুচকি মুচকি হাসি। এই মুচকি হাসির সুবাদেই কিনা জানি না, মহিলা বুথের তাবত মহিলা মহিলা এজেন্টবৃন্দ আপত্তির বদলে হাহা-হিহি শুরু করে দিলেন। এরপর যথানিয়মে জীবনের প্রথম ভোট দিয়ে অধোবদনে বাসায় আসলাম।

যাই হোক এরপর থেকে এখন পর্যন্ত নাম নিয়ে আর কোন ঘটনা বা দূর্ঘটনা কোনটাই ঘটে নাই।
[পূর্বে প্রকাশিত]

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।