পরাধীনতা

তখন বেকার জীবন চলছে। কোন কিছুতে ভর্তি হইনি, কোন কাজ-কর্ম জুটাতে পারিনি। বিদেশ যাবো বা ব্যবসা করবো – চিন্তাটাই মাথায় আনতে সাহস পাই না। কারণ সরকারী চাকরিজীবি পিতার অঢেল সম্পদ নেই যে তিনি আমাকে বিদেশ যাওয়ার বা ব্যবসা করার জন্য টাকা দিবেন। তাই সকাল ১০-১১টা পর্যন্ত ঘুমাই আর আর দুপুরের পর বের হই টিউশনি করতে। সে সময় বেশ কিছু টিউশনি করতাম। মাস শেষে ৪/৫ হাজার টাকা হয়ে যেতো। কিন্তু সমস্যা হলো টিউশনি করে তো আর সারা জীবন চলা যাবে না। অনেকটা হাল বিহীন নৌকার মতো এদিক-সেদিক ঘুরছিলাম। আর ঠিক সেসময়ই প্রথম পড়েছিলাম ইমদাদুল হক মিলনের ‘পরাধীনতা’। অসাধারণ ভাল লেগেছিলো। মনে আছে কয়েক বছর পর যখন স্বল্প সময়ের জন্য প্রবাসী হয়েছিলাম তখন এই বই এর গল্পের দুই নায়কের সাথে নিজের অবস্থার মিল খূঁজে পেয়েছিলাম।

প্রায় ৩৩-৩৫ বছর পর আবার নতুন করে পড়লাম এই বই। বই এ দু’টি গল্প আছে। প্রথমটি পরাধীনতা, দ্বিতীয়টি পরবাস। দু’টি গল্পের পটভূমি জার্মানী, ইমদাদুল হক মিলন সেখানে কিছুদিন সেখানে ছিলেন শুনেছিলাম। হয়তো সেই জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই এই দুই গল্পের উৎপত্তি। প্রথম গল্পের নায়ক লালন, দ্বিতীয়টির আবদুল্লাহ। লালন মূলত জার্মানীতে যায় নিজের এবং সংসারের অবস্থা আরেকটু ভাল করার জন্য। বড় ভাই, ছোট ভাই, বোন, মা এর যৌথ পরিবার। আর আছে সেতু নামের এক প্রেমিকা। সব কিছু ছেড়ে লালন চলে আসে বিদেশে, অমানুষিক পরিশ্রম করতে করতে এক সময় হাপিয়ে উঠে। দেশ থেকে পরিবারের সদস্যরা চিঠিতে কেবল টাকা পাঠানোর আবদার করে। সাধ্য মতো টাকা পাঠানোর পরও তাদের চাহিদা দিনে দিনে বাড়তে থাকে। একমাত্র ব্যতিক্রম সেতু, সেই একমাত্র তাকে সব ছেড়ে দেশে চলে আসতে বলে। আর এই সব নানা ঘটনা, দূর্ঘটনা, শারীরিক পরিশ্রম আর অপমান ভুলতে লালন বিয়ার খেয়ে মাতাল হতে চায় সব সময়।

দ্বিতীয় গল্পের নায়ক আবদুল্লাহর সব কিছুই ছিলো। ছিলো শিক্ষকতার চাকরি, বই আর দু’টি মেয়ে। ছায়া হয়ে ছিলো বড় ভাই আর মা। কিন্তু চাকরিতে তরতর করে প্রমোশন হতে থাকায় অনেকের চক্ষুশুল এ পরিণত হয় সে। ফলশ্রুতিতে মিথ্যা অভিযোগে চাকরি হারায়, গ্রেফতার হয় এবং একসময় শাস্তি এড়াতে দেশান্তরী হয়। বিদেশে এসেও সে ঠিক থিতু হতে পারে না। বয়স বেশী এবং গড়নে একটু ভারী হওয়ায় সে কোন পরিশ্রমের কাজ করতে পারে না। ফলে কিছুদিন পর পরই তার চাকরি থাকে না। এভাবে একসময় দেশে থাকা তার স্ত্রী এবং কন্যার সাথেও তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একসময় আবদুল্লাহ ঠিক করে সে দেশে ফিরবে ৩/৪ বছরের জেলের সাজা মাথায় নিয়ে। যে টাকা জমিয়েছে তাতে বৌ আর মেয়েদের জন্য কিছু করতে পারবে। সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাই আবদুল্লাহ ফিরে যেতে চায় নিজ বাসভূমে।

আপনি যদি কখনও বিদেশে গিয়ে শ্রমিকের জীবন বেছে নিয়ে থাকেন, এই বই এর প্রতি ছত্রে ছত্রে নিজেকে আবিস্কার করতে পারবেন। দেশে পরিবারের টাকার চাহিদা (সবার ক্ষেত্রে হয়তো না)  মেটাতে অমানুষিক পরিশ্রম, বিদেশী হিসেবে নানা ধরণের অপমান হজম করে নেয়া আর কোন কোন করতে না পারলে বিদ্রুপ সহ্য করা – সবই হয়তো আপনার জীবনে সত্য। আমার প্রবাসী এক বন্ধুর কথা মনে পড়ছে। সে যখন প্রথম বিদেশে যায়, জীবন বাঁচানোর সংগ্রামে পত্রিকা বিক্রি করতো রাস্তায় দাড়িয়ে। শিতের সময় শীত নিবারণের জন্য যে পরিমান কাপড়-চোপড় পড়তে হতো তাতে তাকে আর ঠিক মানুষ বলে চেনার উপায় থাকতো না। এরকমই একদিন এক ছোট এক বাচ্চা তার মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো এইটা কোন জন্তু ? জন্তু কথাটি শুনে আমার বন্ধুর চোখে ততক্ষণে পানি চলে এসেছিলো। কিছুই করার ছিলো না। তার মা অবশ্য বাচ্চাটিকে বলেছিলো সরি বলতে, সাথে বলেছিলো সে তোমার মতোই একজন মানুষ, এই শীতে বাইরে দাড়িয়ে সে কাজ করছে। তাকে তোমার সম্মান করা উচিত।

আশা করি বইটি পড়বেন। একই সাথে অনুধাবন করতে পারবেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের শিক্ষিত, অশিক্ষিত কিংবা অর্ধ শিক্ষিত জনগণ কি নিদারুন কষ্ট করে দিনাতিপাত করছে। তাদের পাঠানো টাকায় চলছে তাদের পরিবার, চলছে দেশ।

বইটি পাবেন রকমারি‘তে। বর্তমান মূদ্রিত মূল্য ৩৫০ টাকা।
ভাল থাকবেন। শুভ কামনা।

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।