ফটোগ্রাফির বিষয়

ফটোগ্রাফীর বিষয় যে ঠিক কত রকমের হতে পারে, সে সম্পর্কে মনে হয় আমাদের ধারণা খূবই কম। আমার নিজের একেবারেই নেই বললেই চলে। আমরা আসলে কিছু পূর্বনির্ধারিত ধ্যানধারণা নিয়ে চলি। যেমন ফটোগ্রাফ মানেই চমৎকার সব ল্যান্ডস্কেপ, সুন্দরী নারী কিংবা রাস্তাঘেটে পড়ে থাকা কোন অসহায় মানব সন্তান। ইদানিং হয়তো কিছু কিছু ষ্ট্রিট ফটোগ্রাফি দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফি। এর বাইরে হয়তো আমরা চিন্তাই করতে পারি না। আসলে ফটোগ্রাফির বিষয় এর চাইতে অনেক ব্যাপক। হয়তো এতোসব জানা হতো না ইন্টারনেট না থাকলে। কয়েক বছর আগে ইউটিউবে TED চ্যানেলের কিছু ভিডিও দেখতে গিয়ে আমার নিজের ধারণাই আমূল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিলো। দেখছিলাম তারিন সাইমন (Taryn Simon) নামে একজন আমেরিকান ফটোগ্রাফারের করা কাজ। এই মহিলা (আমার) চিন্তার অতীত সব বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকেন।

তারিনের ওয়েব সাইটে বেশ কিছু কাজের ফিরিন্তি আছে। আমি তার গোটা চারেক কাজ শেয়ার করছি আপনাদের সাথে।

১. Contraband
২০০৯ সালের ১৬ই নভেম্বর থেকে ২০শে নভেম্বর – এই ৫ দিন টানা ছবি তুলেছেন তারিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক জেএফকে এয়ারপোর্টে। কাষ্টম / পোষ্টাল সার্ভিস যেসব জিনিস আটক করে তারিন সেসবের সহস্রাধিক ছবি তুলেছেন। আমাদের দেশে আমরা হয়তো স্বর্ণ, মদ, সিগারেট, ড্রাগস সহ অল্প কিছু নিষিদ্ধ বাইরে থেকে চোরাচালান এর কথা শুনে থাকি। আমেরিকায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ নানা রকম জিনিস নিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছে। তার মধ্যে আছে পাখির দেহাবশেষ (হোম ডেকোরেশন বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো, ইন্দোনেশিয়া), গোবরের টুথপেষ্ট (ভারত), বিভিন্ন ধরণের ঔষধ (পাকিস্তান), ব্রিটিশ আমলের এনফিল্ড পিস্তল (আফগানিস্থান), বিভিন্ন প্রাণীদেহের (হরিণ, কুকুর) বিভিন্ন অংশসহ আরো অনেক জিনিস। এছাড়া বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নকল জিনিস তো ছিলোই। তারিন সাইমনে তোলা ‘কন্ট্রাব্যান্ড’ সিরিজের কিছু ছবি পাবেন এই লিংকে

২. An American Index of the Hidden and Unfamiliar
এই সিরিজে তারিন আমেরিকার ভিতরে এমন কিছু সাইট অথবা জিনিসের ছবি দিয়েছেন যেগুলি সাধারণত লোকচক্ষুর অন্তরালেই থাকে। প্রতিটা ছবির সাথে কিছু বর্ণনা আছে মূল সাইটে। ছবি এবং লেখা মিলিয়ে পূরো কাজটিই হয়ে উঠেছে অসাধারণ। যেমন আছে পারমানবিক বর্জ্য জমা করে রাখার স্থান, প্লেবয় ম্যাগাজিনের ব্রেইল ভার্শন, হাইমেনোপ্লাষ্টি কসমেটিক সার্জারি, সিআইএ’র হেডকোয়ার্টার ইত্যাদি। এই কাজের কিছু ছবি দেখতে পাবেন এই লিংকে

৩. The Innocents
এই সিরিজে তারিন তুলে এনেছেন এমন সব মানুষের ছবি আর কাহিনী যারা মারাত্মক সব অপরাধের জন্য জেল খেটেছেন, অথচ তারা সেই সব অপরাধ আদৌ করেন নাই। সিরিজের শুরুতে একটা বর্ণনা আছে মূল সাইটে, ছবির সাথে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে। পড়তে ভুলবেন না। দেখতে পারেন এই লিংকে

৪. The Living Man Declared Dead and Other Chapters
এই কাজের মূল উপজীব্য – ব্লাডলাইন বা রক্তের সম্পর্ক। তারিন ৪ বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত ঘূরে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন, রিসার্চ করেছেন। তারপর ছবি তুলেছেন। মোট ১৮টি চ্যাপ্টারের প্রতিটা চ্যাপ্টার উপস্থাপনা করা হয়েছে ৩টা ভাগে। প্রথম ভাগে আছে সবার ছবি, রক্ত সম্পর্ক অনুযায়ী সাজানো। এরপরের ভাগে আছে একটা টেক্সট প্যানেল, যেখানে তারিন বর্ণনা করেছেন পূরো গল্পটা। ৩য় ভাগে আছে ফুট নোট। প্রতিটা চ্যাপ্টার তুলে আনতে ঠিক কি পরিমাণ সময় আর ডেডিকেশন লাগতে পারে, সেটা চিন্তা করলে আর্শ্চয হতে হয়।

ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি গ্রাম। যাদব পরিবারের এক সদস্য মারা গেলেন তার ৪ সন্তান রেখে। সন্তানদের একজন সরকারী অফিসে গিয়ে জানতে পারলো সে আর জীবিত নাই, সরকারী রেকর্য অনুযায়ী সে আসলে মৃত। বাকি ৩ সন্তানেরও একই অবস্থা, সরকারী কাগজপত্রে তারা সবাই মৃত। আর যেহেতু তারা মৃত, পৈত্রিক সম্পত্তি পাওয়া থেকেও তারা বঞ্চিত হলো। এই কাজ করেছিলো তাদেরই কিছু আত্মীয়, অসৎ সরকারী কর্মচারীদের উৎকোচ দিয়ে সব রেকর্ডে মৃত দেখিয়ে এই চার জনের পৈত্রিক সম্পত্তি দখলের চেষ্টা শুরু করে। এটা নিয়ে সৃষ্ট মামলা এখনও চলছে। খূব পরিচিত একটা গল্প। আমাদের দেশেও এমনটা ঘটছে অহরহ। জমির জন্য মামলা মোকদ্দমা চলছে বছরের পর বছর। মামলা লড়তে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে লোকজন। কোন কোন ক্ষেত্রে খূন-খারাবী বা দাঙ্গা-হাঙ্গামাও ঘটছে। এরকম সব কাহিনী নিয়েই তার এই কাজ। দেখতে পাবেন এই লিংকে

তারিন সাইমন একজন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার। তিনি যা পারেন আমরা সাধারণ এমেচার ফটোগ্রাফাররা হয়তো সেটা কখনই পারবো না। সময়, শ্রম, অর্থ সবই এখানে বিনিয়োগ করতে হয়। তারপরও একটু চেষ্টা করলে হয়তো আমরা চমৎকার ল্যান্ডস্কেপ, সুন্দরী নারী আর ভূখা-নাঙ্গা মানুষ – এই সব কনসেপ্ট থেকে বের হয়ে আসতে পারবো। আমি বলছি না এসবের ছবি তোলা বৃথা। কিন্তু ভিন্নভাবে চিন্তা করলে হয়তো আপনার ছবি তোলার বিষয়ের কোন অভাব হবে না। চেষ্টা তো করতে পারি, কি বলেন !?!

তারিন সাইমন – উইকিপিডিয়া
তারিন সাইমন – ওয়েব সাইট
ভিডিও লিংক ১
ভিডিও লিংক ২

হ্যাপি ক্লিকিং ….

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।