শখের তোলা আশি টাকা (৫)

অবশেষে অনেক প্রিয় একটি শখের জিনিস ফেলেই দিলাম। নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো, সাথে অনেক ময়লাও হয়েছিলো। অনেকদিন ষ্টোরে থাকায় মরিচা পরে যাতা অবস্থা। ভিতরের অবস্থা আরো খারাপ। পোকা বাসা বেঁধেছিলো। ভিতরে মেটাল / টিন টাইপ যা ছিলো সব জায়গাতেই মরিচা। মিডিয়াম ওয়েভ এর জন্য যে ফেরাইট রড এন্টেনা ছিলো ভিতরে, সেটার উপর পেঁচানো তার ও জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। স্পিকারে যে কাগজ থাকে সেটাও দেখলাম এক কোনায় ছেঁড়া। 

এই অবস্থা দেখে মনে হলো কি দরকার এটা ঘরে রেখে। ফেলেই দেই। ফেলে দেয়ার পর অবশ্য একটু মন খারাপ লাগছিলো। তরুণ বয়সের অনেক বিনিদ্র রজনী কেটেছিলো এই রেডিও নিয়ে। দূরের ষ্টেশন ধরার জন্য রাত জেগে অপেক্ষা করতাম আর আস্তে আস্তে ডায়াল ঘোরাতাম। সে সময়ে মনে পরে হাজার হাজার মাইল দুরের রেডিও ব্রাস (ব্রাজিলের রেডিও ষ্টেশন) সুপার রক কেওয়াইওআই (সাইপান থেকে প্রচারিত মিউজিক ষ্টেশন) কিংবা ডাব্লিউ ডাব্লিউ ভি (টাইম সিগনাল ষ্টেশন, হাওয়াই) শোনার অভিজ্ঞতা ছিলো দারুণ। যদিও রিসেপশন কোয়ালিটি মোটেও ভাল ছিলোনা। সেই অভিজ্ঞতা’কে অনেকটা খড়ের গাঁদায় সূঁচ খোজার সাথে তুলনা করে চলে। বর্তমানের এফএস শ্রোতারা এই মজাটা কোনদিনও পাবেন না। সাধারণ এনালগ রেডিও’তে কোন ফ্রিকোয়েন্সি পিন পয়েন্ট করা সম্ভব ছিলো না। ডায়ালের ছোট একটা অংশে হয়তো অনেকগুলো ষ্টেশন একসাথে থাকতো। একটা থেকে আরেকটা আলাদা করা ছিলো ব্যাপক কঠিন। সে তুলনায় ডিজিটাল রেডিও’তে নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি’তে টিউন করা অনেক সোজা, সোজা বাংলায় জলবৎ তরলং। সেনসিটিভিটি / সিলেক্টিভিটি অনেক ভাল। তারপরও অনেক দূরের ষ্টেশন (নর্থ / সাউথ আমেরিকা, আফ্রিকা) ধরতে পারা ছিলো রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। বেইলী স্কয়ারে থাকতে এক্সটার্নাল এন্টেনা ব্যবহার করার কোন সূযোগ ছিলো না। বাবর রোডে চলে যাওয়ার পর প্রথমেই ছাদে একটা বাঁশ খাড়া করে তারপর তার দিয়ে ইনভার্টেড ভি আকৃতির এন্টেনা তৈরী করেছিলাম। রিসেপশন এরপর অনেক ভাল হয়েছিলো। যে ষ্টেশন গুলোর কথা বললাম, সেগুলো সব এই এন্টেনার জন্যই ধরতে পেরেছিলাম।

Philips D2935

টানা প্রায় ২০ বছর এই রেডিও আমাকে সার্ভিস দিয়ে গেছে। সুইডেনে যাওয়ার সূযোগ হয়েছিলো ১৯৯৮৯ সালে। যাওয়ার সময়ই ঠিক করে রেখেছিলাম যে কোন মূল্যে একটা ডিজিটাল রেডিও কিনতে হবে। অবশেষে ডিসেম্বর মাসেই সেটা কিনতে পেরেছিলাম। ফিরে এসেছিলাম ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারীতে, তখন থেকেই আমার ডিএক্সইং (দুরের ষ্টেশন শোনার হবি) নতুন মাত্রা পেয়েছিলো। ৭/৮ বছর আগে প্রথম নষ্ট হলো ভিতরের পাওয়ার সাপ্লাই। পরিচিত একজন’কে দেখালাম। সে দেখে বললো ভিতরের ট্রান্সফর্মার ফেলে দিয়ে আলাদা করে বানিয়ে দিবে, তবে সেটা থাকবে সেটের বাইরে। সে যাত্রায় আর ঠিক করিনি। কারণ এডাপ্টার ইউজ করে অথবা ব্যাটারি দিয়ে সেট চালানোর ব্যবস্থা ছিলো। সেভাবেই চালাতাম। ব্যাটারী ভিতরে রেখে এডাপ্টার দিয়ে চালাতে গিয়ে একসময় দেখা গেলো ব্যাটারী গলে ব্যাটারি কম্পার্টমেন্ট নষ্ট হয়ে গেছে। ব্যাটারী ফেলে দেয়ার পরও দেখা গেলো নতুন ব্যাটারী দিয়ে আর কাজ হচ্ছে না। এডাপ্টারই ভরসা। এভাবে চলতে চলতে একসময় মনে হলো সেনসিটিভিটি আর আগের মতো নেই। দূরের ষ্টেশন আর আগের মতো টিউন করতে পারি না। একসময় রেডিও শোনা সীমিত হয়ে গেলো কাজের চাপে। কালে ভদ্রে শুনতাম। অনেকদিন পরে থাকার পর যখন আবার পরিস্কার করে টিউন করতে চাইলাম তখন দেখা গেলো ভলিউম বাড়ালে মোটর বোটের মতো ভট ভট আওয়াজ শুরু করেছে। এদিকে অবশ্য রেডিও ষ্টেশনগুলিও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। শর্টওয়েভে বিনিয়োগের পরিবর্তে নতুন নতুন এফএম ষ্টেশন তৈরী হচ্ছিলো সারা পৃথিবীতেই। সেই সাথে বাড়ছিলো স্যাটেলাইট নির্ভর ঠিভি ষ্টেশনের সংখ্যা।

শোনাই যেহেতু হয় না, রেডিও’টা তাই রেখে দিয়েছিলাম ষ্টোরে। মাঝে একবার বের করে চালু করতে গিয়ে দেখলাম ডেড হয়ে গেছে। নতুন এডাপ্টার কিনে এনে চেষ্টা করলাম। কোন খবর নাই। আবার রেখে দিলাম ষ্টোরে। গতকাল বের করার পর দেখি অবস্থা আরো খারাপ। বাংলাদেশের আবহাওয়ার কারণে উপরে যে রাবারের প্রলেপ ছিলো, যার উপর বিভিন্ন সুইচ এবং কি-প্যাড মার্ক করা ছিলো, সেগুলো আগেই ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। পরে একসময় আমি চেছে পূরোটাই ফেলে দিয়েছিলাম। আর্দ্রতার কারণেই হয়তো ভিতরে মরিচা পড়েছিলো, পোকা বাসা বেঁধেছিলো। তাই অবশেষে ফেলে দেয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

এরমধ্যে অবশ্য Tecsun PL-310ET কিনেছি আমাজন থেকে ব্যাকপ্যাকের মাধ্যমে। আরেকটা রেডিও Radiwow R-108 হাতে পাবো অল্প কিছু দিনের মধ্যেই। এগুলো অবশ্য ছোট রেডিও, Philips D2935 এর মতো বড় আর ভারী না। তবে কাজে আরো স্মার্ট। SSB নাই অবশ্য, Radiwow R-108 এ অবশ্য এয়ার ব্যান্ড আছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরো একটা কিনবো শুধূ SSB এর জন্য। সেই সাথে ইচ্ছে আছে SDR – Software Defined Radio নিয়ে কাজ করার।

ভাল থাকুন, আনন্দে থাকুন।

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।