ষ্টকহোম ডায়েরী (২)

সামার বা গ্রীষ্মকাল সুইডেনবাসীর পরম আরাধ্য বিষয়। বছরের বাকি সময় কালে ভদ্রে সূর্যের দেখা মিলে আর উত্তর মেরুর কাছাকাছি হওয়ায় শীতও বেশ প্রবল। তাই সামারে প্রায় সবারই পরিকল্পনা থাকে সূর্যের আলোতে জীবন উপভোগ করার। ফলে প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই কম সংখ্যক কর্মী দিয়ে কাজ চালাতে হয়। তাই সুইডিশ সরকার এই সময় বিদেশীদের কাজ করার ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় থাকে। বিদেশী ছাত্র যারা বিভিন্ন ইউনি’তে পড়াশোনা করে তারা এই সময় কাজ করে পূরো বছরের থাকা-খাওয়ার খরচ তুলে ফেলতে পারে। তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশে অধ্যয়নরত কোন ছাত্র এবং বয়স ৩০ বছরের কম এমন যে কেউ সামারে কাজ করার জন্য আবেদন করতে পারে। ছাত্র এবং বয়স ৩০ বছরের কম এই ২ শর্ত ছাড়াও আরো ২টি শর্ত আছে। কাজ তাকে নিজেই খূঁজে নিতে হবে এবং থাকার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে। মানে হলো সুইডেনে কোন আত্মীয়-স্বজন থাকলে তারা আপনার হয়ে কাজ খূঁজে দিবে এবং থাকার ব্যবস্থা করবে। তাহলেই আপনি ওয়ার্ক পারমিট এবং ভিসার জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে এই নিয়ম এখনও আছে কিনা আমার জানা নাই।

বড়কাক্কার সুইডেনে পোষ্টিং হয় ১৯৮৮ সালে, ২ বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। তার মাধ্যমেই আমার জব হয়েছিলো সুইডেনের অন্যতম গাড়ী প্রস্তুতকারক সাব (SAAB) এর এক কারখানায়। কাগজপত্র পাওয়ার পর ভিসার জন্য আবেদন করলাম। ইন্টারভিউ দেয়ার ৪ সপ্তাহের মধ্যে ভিসা পাওয়ার কথা থাকলেও কি কারণে যেন দেরী হয়েছিলো। ফলে ভিসা পেতে পেতে ১৯৮৯ সালের এপ্রিল মাস চলে আসলো। আমার জব শুরু হওয়ার কথা ছিলো মার্চ মাস থেকেই। অবশেষে পকেটে ৭৫ ডলার আর রিটার্ণ টিকেট নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিমান সংস্থা এরোফ্লতের প্লেনে চড়ে বসলাম। প্রথম ষ্টপেজ বোম্বে (এখনকার মুম্বাই), ঘন্টা খানেক থাকতে হয়েছিলো। রাত বলে উপর থেকে তেমন কিছুই চোখে পড়েনি। আর এয়ারপোর্টও মনে হয়েছিলো ঢাকা এয়ারপোর্টের চাইতে ছোট। ঘন্টাখানেক পর আবার যাত্রা। এয়ারপোর্ট এবং প্লেনে কয়েকজনের সাথে আলাপ হয়েছিলো। সবাই মোটামুটি উইরোপ যাত্রী, কয়েকজন আমার মতোই ষ্টকহোম যাবেন। তারা অবশ্য প্রায় সবাই সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। পরবর্তী ষ্টপেজ মস্কো এয়ারপোর্টে ছিলো ৮ ঘন্টার বিরক্তিকর বিরতি। ইমিগ্রেশনের সময় হলো এক কাহিনী। ইউনিফর্ম পরা ইমিগ্রেশন অফিসার আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে আমার চোখে যে চোখ রাখলেন আর দেখি নামায় না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তো আছেই, পলকও মনে হয় ফেলছিলো না। এমনিতেই আমরা বাঙ্গালীরা চোখে চোখ রেখে কথা বলায় খূব একটা অভ্যস্ত না। কেমন যেন অস্বস্থি লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো চোখে চোখ রেখে একেবারে অন্তরের ভিতর পর্যন্ত দেখতে চাইছিলেন। হাসি তো ছিলই না, মূখের একটা মাসলও নড়ছিলো না। অবশেষে অনন্তকাল পরে মনে হলো চোখ নামালেন এবং পাসপোর্টে সিল দিয়ে ফেরত দিলেন। আমি যতোবার (সব মিলিয়ে ৪ বার) মস্কো এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন পার করেছি, প্রতিবারই একই কাহিনী। কথায় বলে না ‘শ্যেন দৃষ্টি’, সেই শ্যেন দৃষ্টিতে তারা প্রতিটি যাত্রীকে পর্যবেক্ষন করে। প্লেনে আলাপ হওয়া সদ্য পরিচিতদের সাথে আলাপ করেই আসলে এই ৮ ঘন্টা পার করতে হয়েছিলো। ডেনমার্ক যাত্রী এক বাঙ্গালী তরুণকে দেখছিলাম কি যেন মূখস্ত করছে কয়েক পাতা কাগজ থেকে। জিজ্ঞাসা করতেই বললো কোন এক কোম্পানির হয়ে ডেনমার্ক যাছে। কোম্পানি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য মূখস্ত করছে কাগজ থেকে, ড্যানিশ এয়ারপোর্টে জিজ্ঞাসা করলে যাতে বলতে পারে। আসলে সে যাচ্ছিলো এক দালালের মাধ্যমে।

বিরক্তিকর ষ্টপওভার শেষে আবার প্লেনে চড়লাম। এবার সহযাত্রী এক শ্রীলঙ্কান ছেলে। স্বল্পভাষী মনে হলো। কথা বলার এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম সে তামিল না সিংহলী। সাথে সাথেই দেখি তার মূখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বুঝলাম এই প্রশ্ন করা আসলে ঠিক হয় নাই। সেসময় তামিল বিদ্রোহী আর শ্রীলঙ্কান আর্মির মধ্যে যুদ্ধ চলছিলো। আমি ছেলের হাতে আলতো চাপ দিয়ে বললাম সরি ফর দ্য কোশ্চেন। এরপর আর কথা বার্তা খূব একটা আগালো না।

অবশেষে ষ্টকহোম পৌছালাম। লাগেজ নিয়ে বের হতেই দেখি কাক্কা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। বাসায় পৌছে সবার সাথে কুশল বিনিময় হলো। দুই কাজিন অবশ্য সেসময় বাসায় ছিলেন না। দুপুরের খাবার পর আমি আমার জন্য বরাদ্দ রুমে গেলাম, ঘুমাতে।

বিকেলে দুই কাজিনের সাথে দেখা হলো। চা খেতে খেতে সবার সাথে আবার আলাপ। আত্মীয় স্বজনদের খবরাখবর দিলাম। ষ্টকহোম সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেয়া হলো আমাকে। এক কাজিন বললেন রাস্তায় যদি কখনও ন্যাড়া মাথা (স্কিন হেড) কোন লোক দেখি তবে যেন উল্টা দিকে হাটা দেই। এরা নাকি রেসিষ্ট, কয়েক সপ্তাহ আগে এক আফ্রিকান ছেলেকে মেরে ফেলেছে। এমনিতে সুইডিশরা ভাল তবে, কিছুটা রেসিষ্ট। তবে সাধারণ মারমুখি না। ব্যবহার দিয়ে বুঝিয়ে দেয়। আমি অবশ্য পরে অনেকবার এর প্রমাণ পেয়েছি।

কথা বলতে বলতেই রাতের খাবারের সময় হয়ে গেলো। খেতে বসেও দেখি বাইরে রোদ। মনে মনে উসখুস করছি, রাত ৮টা বাজে এখনও সূর্য কেন। শেষ মেষ জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম। উল্টা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো মিড নাইট সান এর কথা শুনছি কিনা। এবার কিছুটা আন্দাজ করতে পারলাম। বড় আম্মা বললো এখন সূর্য ডুবে রাত দশটার পর, আর উঠে ৪টার দিকে। মানে ২৪ ঘন্টার প্রায় পুরোটাই দিন, সামান্য কয়েক ঘন্টা রাত। আবার শীতকালে উল্টো। রাত বড়, দিন ছোট। 

এই বিষ্ময় নিয়েই শুতে গেলাম। কাজিন এসে জানালার কার্টেন টেনে নামিয়ে দিলেন। বললেন এভাবেই ঘুমাতে হবে। সব কার্টেন নামানোর পর মনে হলো রুম বেশ অন্ধকার হয়েছে। কার্টেনগুলি ছিলো চামড়া জাতীয় কিছুর তৈরী। মোটা এবং ভারী।  এক সময় নানা কিছু ভাবতে ভাবতে তলিয়ে গেলাম ঘুমের মধ্যে।

 

 

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।