ষ্টকহোম ডায়েরী (৬)

শারীরিক পরিশ্রমের অভ্যাস না থাকায় প্রথম দিকে দুপুরের লাঞ্চের পর প্রচন্ড টায়ার্ড লাগতো। ট্রেনিং পিরিয়ডে একদিন তো আরেকটু হলে বিশাল দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছিলাম প্রায়। সেদিন কাজ করছিলাম খাদের অংশে যেখানে গাড়ী উঠে পুলের উপর, নিচে নেমে পেট্রোল ট্যাংকের নাট-বল্টু টাইট দিতে হয় সাথে আরো কিছু। তবে গাড়ী সেই পুল  পর্যন্ত আসার ঠিক আগেই হুক লাগানো একটা রড গাড়ীর সাথে এবং একটা ট্র্যাকটরের সাথে লাগাতে হয়। নিয়ম হলো আগে গাড়ীর সাথে লাগানো, তারপর ট্র্যাকটরের সাথে লাগানো। প্রচন্ড টায়ার্ড লাগছিলো। আমি রড নিয়েছি, মনে হচ্ছিলো অনেক ওজন। পাশ থেকে রনির এক এসিট্যান্ট চিৎকার করে বলছিলো ‘আপসাইড ডাউন, আপসাইড ডাউন’। আমি তো প্রথমে বুঝিই নাই কাকে কি বলছে। তারপর খেয়াল করলাম রড নিয়েছি উল্টা করে। গাড়ী বা ট্র্যাকটর কোনটাতেই আটকাবে না। তাড়াতাড়ি উল্টে নিলাম। এরপর দ্বিতীয় ভুল করলাম। আগে ট্র্যাকটরে আটকালাম। গাড়ীতে আটকাতে গিয়ে দেখি গাড়ী আর ২ হাত দূরে। ট্র্যাকটরে লাগিয়ে ফেললে সেটা আর খুলে না, একদম শেষ মাথায় গিয়ে রিলিজ হয়। পুরা বোকা হয়ে গেলাম, সেই সাথে পেলাম ভয়। রনির যে এসিট্যান্ট শুরুতে সাবধান করেছিলো, সে দৌড়ে এসে আরেকটা রড তুলে ঝটপট লাগিয়ে ফেললো। আর আমি আগে লাগানো রড খাড়া করে ধরে রাখলাম। রিলিজ হওয়ার পর সেটা রেখে আসলাম। রনি এসে পিঠে চাপড় দিয়ে বললো ইটস ওকে। এরপর বললো কফি খেয়ে আসো, টায়ার্ড লাগতেছে। কফি খেতে খেতে ভাবলাম খাওয়া দাওয়ার পরিমাণ বাড়াতে হবে। না হলে যে কোনদিন বড় ধরণের ঘাপলা করে ফেলতে পারি।

পরের দিন কাজে যাওয়ার সময় আর নাশতা করলাম না। সবগুলো স্যান্ডউইচ নিয়ে নিলাম টিফিন বক্সে। রাত ৮টার দিকে ডিনার করে ভোর ৪টায় আসলে ক্ষুধা লাগে না। এ কয়দিনে দোকানপাট কিছু চিনেছি। বাসার কাছে গ্রোসারি ষ্টোরে দেখেছিলাম কাগজের বক্সে দূধ এবং নানা রকম ফলের রস পাওয়া যায়। বাসার ফ্রিজেও বড় একটা দূধের প্যাকেট ছিলো। আমি বের হওয়ার আগে এক গ্লাস ঠান্ডা দূধ খেয়ে নিলাম। কারখানায় নাশতার সময় কারখানার স্যান্ডউইচ একটা আর বাসার স্যান্ডউইচ ১টা খেলাম। সাথে ১/৪ লিটার দূধ কিনে খেলাম। সাথে কফি। দূপুরে খাওয়ার সময় কারখানার স্যান্ডইউচ ১টা আর বাসার তৈরী বাকি স্যান্ডউইচ খেলাম। সাথে যথারীতি দূধ। পরে কফি। এরপর থেকে মোটামুটি এই নিয়ম ফলো করেছি যে কয়দিন এখানে কাজ করেছিলাম। পানি শুধূ বাসায়, বাইরে থাকলে পিপাসা পেলে সব সময়ই দূধ, কালেভদ্রে ফলের রস।

ট্রেনিং এর সময় আরেক ঘটনা ঘটলো। সেদিন কাজ লাইনের একদম শেষ মাথায়। এখানে গাড়ী আসলে, গাড়ী ষ্টার্ট দিয়ে লাইন থেকে বের হয় সোজাসুজি একটা গ্যারেজের মতো অংশে ঢুকাতে হয়। সামনে পিছনে আমাদের দেশের গ্যারেজ বা দোকানের শাটারের মতো, তবে মোটর দিয়ে উঠে নামে। গাড়ী ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে গাড়ীর চেসিস এর কয়েক অংশে তেল এবং কালো রং স্প্রে করতে হয়। কাজ শেষে সামনের শাটার খুলে দিলে একজন ওয়ার্কার এসে সেটি চালিয়ে নিয়ে নতুন তৈরী হওয়া সারিবদ্ধ গাড়ীর পাশে রেখে আসে। 

কাজের শুরুতে আকবর যখন আমাকে বললো কি করতে হবে, আমি বেরসিকের মতো বললাম আমি তো গাড়ী চালাতে পারি না। আকবর গিয়ে রনিকে বললো। আকবর অবশ্য বুঝেছিলো, কারণ ও তো এশিয়াতেই বড় হয়েছে। রনি একটু ফাঁপড়ে পড়ে গেলো। পরে অবশ্য বললো তোমাকে আসলে চালাতে হবে না। তুমি ষ্টার্ট দিবে, গাড়ী লাইভ হবে মানে জ্যান্ত হবে। এরপর জাষ্ট ষ্টিয়ারিং হুইল দিয়ে গাড়ীর চাকা সোজা রাখবে, সেই সাথে এক্সিলারেটর চাপতে হবে। জায়গা মতো গিয়ে ব্রেক করে ষ্টার্ট অফ করে দিতে হবে। জলবৎ তরলং। প্রথম দুবার আকবরই গাড়ী চালায়ে নিয়ে গেলো, আমি পাশে বসে দেখলাম। ভিতরে গিয়ে আমিই কাজ করলাম। আকবর কেবল দেখিয়ে দিলো কোন কোন জায়গায় স্প্রে করতে হবে। তৃতীয়বার আমাকে বসতে হলো। আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার জোগাড়। ষ্টিয়ারিং একহাতে ধরে চাবি ঘুরালাম, গাড়ী কো কো করা শুরু করলো। আকবর পাশ থেকে বললো এক্সিলারেটর দাবাও। দাবাতেই দেখি গাড়ী সামনে আগাতে শুরু করেছে। আকবর পাশ থেকে ষ্টিয়ারিং হুইল একটু ঘুরিয়ে দিলো। প্রায় শেষ সীমায় এসে আকবর বললো ব্রেক, আমি এক্সিলারেটর চাপলাম। আকবর আমার পায়ের উপর দিয়ে পা দিয়ে ব্রেকে চাপ দিলো। আমি চাবি উল্টা ঘুরালাম। গাড়ী থামলো, নামতে গিয়ে দেখি আমার সাইডের দরজা খোলা যাচ্ছে না। অন্য দরজা দিয়ে নামার পর দেখি গাড়ী কোনাকুনি হয়ে দাড়িয়ে আছে, আরেক হাত এগোলেই পাশের ওয়ালে ধাক্কা দিতো। রনি চলে আসলো। সবকিছু দেখে বললো, লাইনে এমাথায় যখন কাজ পড়বে আমাকে আগেই স্মরণ করিয়ে দিবে। অন্য কেউ গাড়ী ভিতরে নিয়ে আসবে, তুমি বাকি কাজ করবে। এরকম হলে যে কোন সময় বড় এক্সিডেন্ট হতে পারে।

এই মাথায় অবশ্য আরো একবার কাজ করতে হয়েছিলো। সেসময় স্যাম নামের এক ছেলে গাড়ী চালিয়ে ভিতরে ঢুকতো, আমি বাকি কাজ করতাম। ধন্যবাদ দেয়া ছাড়াও কফি বা কোক খাওয়াতাম ব্রেকের সময়।

খাদের অংশে কাজ করার সময় আরেকদিন আরেক ঘটনা ঘটেছিলো। তবে সেটা আমার জন্য হয়নি। আগের কোন এক ষ্টেজে পেট্রোল ট্যাংক লাগানো হয়েছিলো। একটা স্ক্রু ঠিকমতো লাগানো হয় নাই, কোন রকমে ছিদ্রে আটকে ছিলো। আমি যখন টাইট দিতে গেলাম ট্যাংক ভর্তি পেট্রোল। আগের ষ্টেজে পেট্রোল ভরে ষ্টার্ট দিয়ে দেখা হয় ইঞ্জিন ঠিকমতো কাজ করে কিনা। আমি জায়গামতো স্ক্রু ড্রাইভার ধরে ট্রিগার চেপে ধরেছি, কোন রকমে লাগানো সেই স্ক্রু ছিটকে গেলো। আর পেট্রোল ট্যাংক কাত হয়ে আমার মাথার উপর পেট্রোল ঢেলে দিলো। রনি আর তার এসিট্যান্টরা তো সদা তৎপর, একজন নেমে এলো খাদে আমাকে বললো তুমি উঠে ফার্ষ্ট এইড নাও। উপরে উঠে আসতে রনি এবং আরো একজন বোতল থেকে কি যেন স্প্রে করা শুরু করলো। প্রথমে বুঝি নাই কি জিনিস, পরে রনি বললো ডিষ্টিল ওয়াটার। আমাকে চোখ খোলা রাখতে বললো, যাতে পানিতে সব পেট্রোল ধূয়ে যায়। এবারও কফি খেতে পাঠানো হলো। ফিরে আসার পর শুনলাম দোষটা আসলে যে প্রথম পেট্রোল ট্যাংক সেট করেছিলো তার। বাকি সময় নির্বিঘ্নেই কাজ করলাম।

কাজ শুরু করার সপ্তাহ দেড়েক পর বাসায় এসে একটা চিঠি পেলাম কারখানা থেকে, পুরোটাই সুইডিশ ভাষায়। কাজিন কিছু সুইডিশ বুঝতো, তাকেই দেখালাম। সে পড়ে বললো পেমেন্ট সংক্রান্ত বিষয়। সুপারভাইজারকে দেখাতে বললো। পরদিন রনিকে দেখালাম। ও পড়ে বললো্ তোমাকে ব্যাংকে যেতে হবে একদিন। এই চিঠি দেখালে তোমার একাউন্ট ওপেন হবে। সপ্তাহ শেষে টাকা সরাসরি ব্যাংকে জমা হবে। কাজের শেষে গিয়েছিলাম নাকি শনিবারে গিয়েছিলাম, মনে করতে পারছি না। ব্যাংকে গিয়ে দেখি তেমন ভিড় নেই। সেখানেও সিরিয়াল, তবে লাইনে দাড়াতে হয় না। মাঝামাঝি জায়গায় একটা ষ্ট্যান্ডে গোলাকার একটা মেশিন, কাগজ বের হয়ে আছে। কাজিন আগেই এসম্পর্কে বলেছিলো। কাগজ ধরে টান দিলে সেটা ছিড়ে আসবে। কাগজে আমার সিরিয়াল নাম্বার। কাগজ নিয়ে ওয়েট করছি। ডিজিটাল ডিসপ্লে’তে আমার নাম্বার আসতেই এগিয়ে গেলাম ডেস্কে। একটা মেয়ে এসে হেই (Hej, সুইডিশ ভাষায় হাই) বলে সুইডিশে কি সব বললো। আমি দূঃখিত বলে ইংরেজীতে কথা বললাম। চিঠি তার হাতে দিতেই সে একগাল হেসে বললো ওয়েট করো। ফিরে আসলো সিল করা একটা এনভেলপ নিয়ে। আমার হাতে দিয়ে বললো খুলো। খুললাম, আমার কাছ থেকে ভিতরের কাগজপত্র নিয়ে দু’টো কাগজ দিলো নাম, ঠিকানা লিখে দেয়ার জন্য। লিখে দিতেই বললো তোমার একাউন্ট হয়ে গেছে। মিনিট পাঁচেক ওয়েট করলে টাকা তুলতে পারবে। আমি ওকে বলতেই একটা কাগজ নিয়ে চলে গেলো, বাকি সব আমার কাছেই থাকলো। ভিতরে দেখলাম একটা পিভিসি কার্ড আছে। মেয়েটা ফিরে আসতেই ওকে বললাম এটা কি জিনিস। বললো ব্যাংক কার্ড, পথের ধারের মেশিন থেকে টাকা তুলতে পারবো। সাথে একটা সিল করা কাগজ দেখিয়ে বললো এটাতে একটা নাম্বার আছে, টাকা তোলার সময় লাগবে। তবে এই নাম্বার অন্য কেউ জানলে সমস্যা। মেয়েটা ব্যাংক থেকে ফর্ম ফিলআপ করে কিভাবে টাকা তুলতে হয় দেখিয়ে দিলো। এরমধ্যে সে আমাকে একটা ষ্টেটমেন্টও দিয়েছে ব্যাংকে কত টাকা জমা আছে সে বিষয়ে। আমি প্রথমে খূব অবাক হয়েছিলাম কোন চেক ছাড়াই টাকা তোলা যাবে দেখে। আর সেই কার্ড আর পথের ধারের মেশিন থেকে টাকা তোলার বিষয় তো একদমই নতুন। আসা-যাওয়ার পথে এই মেশিন তো কয়েকটা দেখেছি। সাধারণত কোন বিল্ডিং এর ওয়ালে ফিট করা, তবে এখনকার এটিএম মেশিনের চাইতে সাইজে বড়। আলাদা কোন ঘর নাই, কোন সিকিউরিটি গার্ডও থাকতো না।

যাই হোক। সেদিন ব্যাংকের সেই মেয়েটা আমাকে ফর্ম ফিলআপ করতে সাহায্য করলো। ফিলআপ করা ফর্ম নিয়ে কাউন্টারে দাড়াতেই কচকচে কতগুলো নোট হাতে পেয়ে গেলাম দু’মিনিটেই। প্রবাসে আমার প্রথম আয়।

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।