হ-য-ব-র-ল (৫)

১. কয়েক বছর আগের কথা। শাহবাগে কি একটা কাজ ছিলো, বাসে করে যাচ্ছি। শাহবাগে বাস থেকে নেমেই তাড়াহুড়া করে রওনা দিলাম। আমি নেমেছিলাম বারডেম এর সাইডে, যাবো পিজির সাইডে। বাস ষ্ট্যান্ডের সাথেই ফুটওভার ব্রিজ ছিলো। কিন্তু আমি রাস্তা ক্রস করতে উদ্যত হলাম। যে বাস থেকে নেমেছিলাম তার পিছনে তখন আরো কয়েকটা বাস থেমে আছে, যাত্রী উঠছে-নামছে। আমি থেমে থাকা বাসের সারির সামনে দিয়ে এগিয়ে গেলাম। আর ঠিক তখনই কোথা থেকে একটা বাস মনে হলো উড়ে এলো প্রচন্ড গতিতে। রিফ্লেক্স একশনে আমার হাত দু’টো সামনে চলে এলো চলন্ত বাসটিকে থামিয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে। মনে হলো হাতে প্রচন্ড ধাক্কা লেগে বাসটি থেমে গেলো। আসলে ড্রাইভারও মনে হয় শেষ মূহুর্তে আমাকে দেখেছিলো, সাথে সাথেই হার্ড ব্রেক করেছে। প্রচন্ড ধাক্কায় আমি দু’পা পিছিয়ে এসেছিলাম, কিন্ত কেমন করে যেন ব্যালান্স ঠিক রাখতে পেরেছিলাম। আমি আস্তে আস্তে থেমে থাকা বাসের সামনে দিয়ে মাঝের আইল্যান্ডে উঠে এলাম। বাসের ভিতর থেকে তখন যাত্রীরা গালি দিচ্ছে। আমি কেবল ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসেছিলাম। এক পিচ্চি হকার আমার হাত ধরে বলছিলো ‘কাক্কা, আমি ভয় পাইছিলাম।’

শিক্ষা হলে একবারেই হয়। আমি এরপর থেকে কখনই তাড়াহুড়া করে রাস্তা পার হই না। ফুটওভার ব্রিজ থাকলে সেটা দিয়েই পার হই, প্রয়োজনে একটু হেটে হলেও ফুট ওভার ব্রিজে উঠি। যেখানে ফুট ওভার ব্রিজ নেই সেখানে চৌরাস্তা বা তিন রাস্তার মোর দিয়ে পার হই। কারণ সিগনালে গাড়ি থামে, তখন পার হই। যে শহরে প্রতিদিন ৩/৪ ঘন্টা নষ্ট হয় ট্র্যাফিক জ্যামে, সেখানে মাত্র কয়েক মিনিট বাঁচানোর জন্য জীবনের ঝুঁকি নেয়া ঠিক না।

সেদিন হাত সামনে বাড়িয়ে দেয়ায় যে প্রচন্ড ধাক্কা খেয়েছিলাম তাতে মনে হয় শরীরের সব কলকব্জা নড়ে গিয়েছিলো। বেশ অনেকদিন পর্যন্ত সারা শরীরে ব্যথা ছিলো।

২. গতকাল আবরার নামে এক ছাত্র বাস চাপায় মারা গেছে। পত্রিকায় দেখলাম সে জেব্রাক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় ড্রাইভার চলন্ত বাস না থামিয়ে তার উপর উঠিয়ে দেয়। আগে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গাড়ী বের হয়ে আড়াআড়ি রাস্তা ক্রস করে কুরিল বিশ্ব রোডের দিকে যেতো। সেসময় দুই দিকের গাড়ী থেমে থাকতো। তৈরি হতো যানজট। এই সূযোগে মোটামুটি নিরাপদেই রাস্তা পার হওয়া যেতো। যানজটের অজুহাতে মাঝের ফাঁকা অংশটি বন্ধ করে দেয়ায় এখন আর কোন গাড়ী থামেনা। ফলে রাস্তা পার হওয়া রীতিমতো বিপদজনক। এমনিতেই আমরা কেউ ট্রাফিক নিয়ম কানুন মানতে চাই না, জেব্রাক্রসিং যে গাড়ী থামতে হয় সে বোধটা কোন ড্রাইভারের নেই। 

৩. আমরা কেউ আসলে ট্রাফিক আইন জানি না অথবা মানতে চাই না। আবরার হয়তো নিয়ম মেনেই জেব্রাক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু ড্রাইভার আইন না মানায় মূহুর্তেই ঘটে গেছে দূর্ঘটনা।

রাস্তায় বের হলে যারা গাড়ীতে চলাচল করে তারা দোষ দেয় পথচারীর, পথচারী দোষ দেয় গাড়ীওয়ালাদের। অথচ আমরা দু’পক্ষই যে সমান দোষী এবং ভুক্তভোগী, সেটা কেউই বুঝতে চাইনা। রাস্তায় বের হলেই দেখা যায় কিছু লোক চলন্ত গাড়ীর মধ্যে দিয়ে হাত তুলে একে বেকে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করে। তাদের এমন একটা ভাব থাকে যেন তারা বিশাল কিছু করে ফেলছেন। আবার গাড়ী চালকেরা (রিক্সা থেকে শুরু করে বাস পর্যন্ত সবই) কি আর হবে মনে করে অহরহই ট্রাফিক আইন ভাঙ্গছেন। আমাদের ট্রাফিক পুলিশ আর সার্জেন্টরা আরেক কাঠি সরেস। ট্রাফিক সপ্তাহে ব্যাপক ঢাক ঢোল পিটিয়ে হাজার-লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় করার পরও ট্রাফিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে পারছেন না। তাহলে গলদটা কোথায় !?!

৪. ইদানিং আবার রাইড শেয়ারিং সিষ্টেম চালু হওয়ায় যাতায়াতে স্বস্তি দেয়ার পরিবর্তে অনেকটা গলার কাঁটা হয়ে উঠছে। কিছু এক্সট্রা ইনকামের আশায় অনেকেই নতুন পুরাতন গাড়ী / মোটর সাইকেন কিনে নেমে পড়ছেন বিভিন্ন রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের ব্যানারে, ফলাফল সীমিত সড়কে জ্যাম বহুগুণ বেড়ে গেছে। তার উপর যানজট কমানোর জন্য মেট্রো রেল সহ আরো বেশ কিছু মেগা প্রজেক্ট চলছে ঢাকায়। অথচ কেউ এনিয়ে আগাম চিন্তা ভাবনা করেছে বলে মনে হয় না। আবার আমাদের বাইকারবৃন্দ তো মনে করেন তারা বিশেষ শ্রেণীর, জ্যাম দেখলেই সদলবলে উঠে পরেন ফুটপাথে।

৫. ঘাপলা আসলে আমাদের সিষ্টেমে। আইন না মানা, টুপাইস দিয়ে ম্যানেজ করে ফেলা, সেই সাথে ঘুষ খাওয়ার অবাধ সংস্কৃতি আর ‘আমি কি হনুরে’ সিন্ড্রোম বছরের পর বছর চলতে থাকায়  পুরো সিস্টেমই এখন মুখ থুবরে পরেছে। ট্রাফিক সপ্তাহে প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে মামলা আর লক্ষ লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় করতে পারলে অন্যান্য দিন কেন সেটা হয় না ? এমন তো না যে, ট্রাফিক সপ্তাহ উপলক্ষে বিশেষ কোন আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। যে ট্রাফিক আইন বলবত আছে সেই আইনেই সব কিছু হচ্ছে। তাহলে অন্যান্য দিন শ’য়ে শ’য়ে মামলা কিংবা লক্ষ লক্ষ টাকা জরিমানি আদায় হয় না কেন ? ট্রাফিক পুলিশ আর সার্জেন্টরা কি তখন পথচারী আর গাড়ী চালকদের এক্সট্রা খাতির করেন ?

বিদ্যমান ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে মানা হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরতে বাধ্য। একজন গাড়ী চালক যদি কয়েকদিন আইন অমান্যের জন্য কয়েক শত থেকে কয়েক হাজার টাকা জরিমানা দিতে বাধ্য হয়, সেই সাথে কয়েকবার আইন অমান্যের জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিলের ব্যবস্থা নেয়া হয় তাহলে সে এমনিতেই আইন মানতে বাধ্য হবে। সেই সাথে তার নিয়োগ কর্তাও সাবধান হবে এমন চালক নিযুক্ত করতে। আবার নিজেই নিজের গাড়ী চালালেও সে সাবধান হবে আইন সম্পর্কে। সুইডেনের চমৎকার ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে জনৈক সুইডিশ বলেছিলো ‘দুনিয়ার সব গাড়ী চালকই নিজেকে এফ১৬ এর পাইলট মনে করে। তাকে আকাশে উড়তে বাধা দেয়া হয় কেবল প্রচুর জরিমানা আর কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে।’

ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন। আইন মেনে চলুন।

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।