কাবিখা মানে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী। বাংলাদেশ সরকরের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য শ্রমিকদের সরাসরি অর্থ না দিয়ে খাদ্যশষ্যের মাধ্যমে তাদের শ্রমমূল্য পরিশোধ করা হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কাজের সূযোগ সৃষ্টি এবং খাদ্যশষ্যের সরবরাহ এবং প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা ছিলো অন্যতম উদ্দেশ্য।
তবে আজকের লেখার বিষয় আসলে ফেসবুকে ঘুরে বেড়ানো একটি ছবি। আসলে এটি একটি বিজ্ঞাপন। পথ চলতে দেখা যায় কোন ওয়ালে বা ল্যাম্প পোষ্টে সাটানো থাকে পড়াইতে চাই, বাড়ী ভাড়া ইত্যাদি টাইপের সাদা কাগজে কম্পিউটার কম্পোজ করা। সেরকম ই একটি বিজ্ঞাপনের ছবি তুলে কেউ একজন আপলোড করেছে ফেসবুকে। বিজ্ঞাপনের মূল ভাষ্য “শুধূমাত্র ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই”। এই বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই আহা-উহু করছেন।
আসলে আমরা যারা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি তারা হয়তো কোনদিন চিন্তাও করতে পারবো না এই দেশে শুধূমাত্র বেঁচে থাকার জন্য মানুষ কি করে। শুরু করি আমার বাবা-চাচার কাহিনী দিয়ে। দাদার অবস্থা ভালই ছিলো। কিন্তু তিনি যখন মারা যান তার আপন ভাই এর চক্রান্তে আমার বাবা-চাচাদের চলাই মুশকিল হয়ে গিয়েছিলো। বড় চাচার বয়স ছিলো বছর দশেক আর ছোট চাচার ৪০ দিন। ৪ ভাই, ১ বোন আর আমাদের দাদী। বিভিন্ন জায়গায় জায়গীর থেকে প্রথম ৩ ভাই কোন রকমে টিকে ছিলেন। এক সময় দাদীও অনাহারে, অর্ধাহারে থেকে এবং প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান। এপর্যায়ে এসে বাবা-চাচা ৫ ভাইবোনের দায়িত্ব নেন দাদারই আরেক ভাই, যার নিজেরও ছিলো ৬ মেয়ে ১ ছেলে॥ এই ১২ জনের দায়িত্ব তিনি পালন করে গেছেন। প্রত্যেকেই পড়াশুনা করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
কয়েকটা কাহিনী বলি। বড়চাচা ছোট থাকতে হাটবারে দিয়াশলাই বিক্রি করতেন ফেরী করে। সামান্য লাভ হতো। আব্বা দাদীর পালা ছাগলের দূধ বিক্রি করতে নিয়ে যেতেন বাজারে। এভাবেই বড় হয়েছেন। বড়চাচা আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সময় একবার বাসে করে যাওয়ার সময় মাথা ঘুড়িয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তার সেদিন কোন খাওয়া হয় নাই, টাকার অভাবে। বাসের যা্ত্রী এক সহৃদয় ভদ্রলোক বিষয়টি বুঝতে পেরে বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে এক ঠোঙ্গা মুড়ি কিনে দিয়েছিলেন। এভাবেই তারা সবাই বড় হয়েছেন।
আমি কোন এক সময় হাতিরপুলে এক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম। মফস্বল থেকে আগত এক ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার সেখানে কাজ করতো। আরো অনেকেই ছিলো, কিন্তু এই ছেলেটা ছিলো অনেক হাসি-খুশি আর আলাপি। একদিন কোন এক কারণে ঠিকাদার ভদ্রলোক এই ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোকের উপর ক্ষেপে গেলেন। বকাবকির এক পর্যায়ে ঠাস করে করে এক চড় মেরে বসলেন। আমি তখন রুমেই ছিলাম। পুরো স্তম্ভিত এবং বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। ঠিকাদার সাহেব তখন আরো বেশী উত্তেজিত আর সেই ছেলেও আরো কি কি বলতে চাইছিলো। আমি আর কেয়ারটেকার মিলে তাকে ঠেলে বারান্দায় নিয়ে গেলাম। আর ঠিকাদার সাহেবকে অনুরোধ করলাম কিছুক্ষণ পর যেন ডেকে নিয়ে কথা বলেন। পরে শুনেছিলাম ঠিকাদার সাহেবের জন্য এটা নতুন কোন বিষয় না। ইঞ্জিনিয়ার হোক আর কেয়ারটেকার হোক, হরহামেশাই চড়-থাপ্পর মারেন।
যাই হোক। পরে সেই ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে আলাপ করতে গিয়ে চরম অবাক হয়েছিলাম। সে আগেও নাকি এরকম চর-থাপ্পর খেয়েছে। তার কোন বিকার নাই। সে চাকরি করেই যাচ্ছে। কারণ কি জানতে চাইলে বললো একজনের রেফারেন্সে সে এসেছিলো এই প্রতিষ্ঠানে। ঢাকাতে তার কোন থাকার জায়গা নাই, চাকরি নাই। পকেটে সামান্য কিছু টাকা। সেই সময় এই ঠিকাদার ভদ্রলোক তাকে তার অফিসেই থাকতে দিয়েছিলেন। কেয়ারটেকারের সাথে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় তার কোন কাজ রানিং না থাকায় কোন চাকরি দিতে পারেন নাই। এভাবে ৬-৭ মাস চলার পর চাকরি হয়েছিলো। এই অচেনা-অজানা ঢাকা শহরে যে লোক কেবল এক রেফারেন্সের জোরে তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তার ২/১টা চড়-থাপ্পর তো কিছুই না। কেয়ারটেকারও প্রায় একই ধরণের কাহিনী শুনিয়েছিলো সেদিন। ৯ বছর ধরে চাকরি করছে। কি এক মায়ায় জড়িয়ে গেছে সবাই। ইঞ্জিনিয়ার শেষ কথা বলেছিলেন এরকম – আপনি আমার অবস্থা কোনদিনই বুঝবেন না, কারণ এরকম পরিস্থিতিতে আপনি কখনই পড়েন নাই।
পিরিয়ড !!!
ফেসবুক মন্তব্য