১. এই ঘটনা অবশ্য শুনেছিলাম আরো অনেক পরে। আব্বা তখন সদ্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বদলি হয়ে এসেছেন। ঢাকা পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট এর প্রিন্সিপাল ছিলেন তখন ভদ্রলোক। আমি তখন খূবই ছোট। ওনাকে বড়জোর ২/৩ বার দেখেছি।
ভদ্রলোক তরুণ বয়সে গিয়েছিলেন লন্ডনে পড়তে। সাথে ছিলেন তারই হরিহর আত্মা এক বন্ধু। দিন যায়, প্রবাস জীবনে তাদের বন্ধুত্ব আরো গাঢ হলো বলা চলে। আত্মীয়-স্বজন হীন পরিবেশে সুখ-দূঃখের কথা বলার জন্য এই একজনই। দুজনেই নিজের নিজের মনের কথা শেয়ার করেন অন্যজনের সাথে। দেশের কথা, পরিবারের কথা কিছুই বাদ যায় না।
এরকম সময়ে বন্ধু একদিন উত্তেজিত হয়ে ঘরে আসলেন। ঘটনা কি !?! দেশে তার পরিবার তার জন্য একজন মেয়ে দেখেছেন, বিয়ের জন্য। মেয়ের মা নাকি ব্রিটিশ মহিলা। এক বাঙ্গালীর সাথে গাটছড়া বেধেছিলেন। তাদেরই মেয়ে। মেয়ে দেখতে নাকি অসধারণ সুন্দরী। বন্ধু বাড়ী থেকে আসা চিঠি, ছবি সবই দেখতে দিলেন, বরাবরের মতোই।
ভদ্রলোকের মনে তখন কি ভাবের উদয় হয়েছিলো জানা নাই। তিনি সন্তর্পনে মেয়ের পরিবারের ঠিকানা ইত্যাদি দেখে নিলেন। তারপর কয়েকদিনের মধ্যেই দেশে জরুরী প্রয়োজনের কথা বলে চলে আসলেন দেশে।
এরপর !?! এরপর আর কি। বন্ধুর জন্য মনোনিত পাত্রীকে তিনি নিজেই বিয়ে করলেন। আর সেই সাথে তাদের বন্ধুত্বের ও ইতি ঘটলো।
২. আমার বাবা-চাচারা খূব ছোট বেলায় এতিম হন। দাদা যখন ৩৬ বছর বয়েসে মৃত্যুবরণ করেন তখন বড়চাচা ৮ বছরের বালক আর ছোটচাচা ৪০ দিনের শিশু। ৪ ছেলে আর ১ মেয়েকে নিয়ে দাদী চরম দারিদ্রের মধ্যে পড়েন। অবস্থা এতোটাই খারাপ ছিলো যে প্রথম ৩ ছেলেকে স্বচ্ছল আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় জায়গীর দেন যাতে তারা ৩ বেলা খেতে পারে। এভাবে চললো কিছুদিন। দাদা মারা যাওয়ার ৫ বছরের মাথায় দাদীও মারা গেলেন অর্ধাহারে থেকে আর বিনা চিকিৎসায়। বাবা-মা হীন এতিম সন্তানদের দেখার আর কেউ রইলো না।
ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে এগিয়ে এলেন তাদের সেঝচাচা। সরকারী চাকরি করে নিজের ৬ মেয়ে আর আর ১ ছেলেন সাথে আরো ৫ জনের দায়িত্ব নেয়া কিন্তু সহজ ছিলো না। কিন্তু তারপরও তিনি তাদের দায়িত্ব নিলেন। সরকারী চাকরির সুবাদে তিনি যেখানেই গেছেন এই ১২ জন তার আর তার স্ত্রীর অনুগামী হয়েছে।
নিজের ছেলে-মেয়ের সাথে ভাই এর ছেলে-মেয়েরাও পড়াশোনা করেছেন। বড়চাচা একদিন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে বুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সেখানেই শিক্ষকতায় যুক্ত হলেন।
এর মধ্যে সেঝচাচার বড় মেয়েরও বিয়ে ঠিক হয়েছে একজন ডাক্তারের সাথে। কার্ড ছাপাতেও দেয়া হয়েছে। বড়চাচা নতমুখে সেঝচাচার সামনে গিয়ে জানালেন তিনি তার বড়মেয়েকে বিয়ে করতে চান। সেঝচাচা অবাক হওয়ার চাইতে খুশী হলেন বেশী।
সেই ডাক্তার পাত্র আর তার পরিবারকে কি বলে বুঝ দিয়েছিলেন জানা নাই। তবে বড়চাচার সাথেই তার বিয়ে হয়েছিলো।
পাদটিকা : বড়চাচা আগে থেকেই একটু গম্ভীর প্রকৃতির। ১২ জনের মধ্যে বয়েসে বড় হওয়ার কারণে বাকি সবাই তাকে বড় ভাই বলেই ডাকতেন। বিয়ের পর তার নতুন শ্যালিকাদের কেউ একজন গিয়ে তাকে দুলাভাই বলে সম্বোধন করেছিলেন। তিনি নাকি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন যে তিনি আজীবনই বড় ভাই থাকবেন। দরকার মনে করলে তাদের বোনকে যেন তারা ভাবী বলে ডকে।
৩. এরপরের কাহিনী আমার বাবার। আব্বা ইন্টারমিডিয়েটে নাকি ফেল করেছিলেন। এপর গিয়ে ভর্তি হন ডিপ্লোমায়। সেখান থেকে পাশ কিছুদিন সিএন্ডবি (বর্তমানের পিডাব্লিউডি) তে চাকরি করেন। এরপর ঢাকা পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউটে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
তাদের সেঝচাচার প্রথম ও দ্বিতীয় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আব্বার মনে কি ভাবের উদয় হলো কে জানে। তিনি কাউকে একটা চিঠি লিখলেন যে তিনি সেঝচাচার সেঝমেয়েকে বিয়ে করতে চান। সাথে একটু প্রচ্ছন্ন হুমকি ‘বিয়ে না হলে তিনি বিবাগী হবেন’। শোনা যায় সেঝমেয়ের নাকি কিঞ্চিত আপত্তি ছিলো, কিন্তু সেঝচাচা সানন্দেই ভাতিজার আর সাথে মেয়ের বিয়ে দিলেন।
মানে বাবা-চাচাদের সেই সেঝচাচা বন গিয়া মেরা নানা। আমি অবশ্য তাকে দেখি নাই। তার মৃত্যুর তয়েক বছর পর আমার জন্ম।
ফেসবুক মন্তব্য