পোষ্ট অফিসে কাজ শুরু করার পর কিছুটা হীনমন্যতায় ভূগছিলাম। ক্লিনিং জব করি, দেশে তো নিজেরাই এরকম লোকদের দুই পয়সা দাম দেই না। তবে কিছুদিনের মধ্যেই এই হীনমন্যতা কাটিয়ে উঠেছিলাম। প্রথমত পোষ্ট অফিসের চমৎকার সব কর্মীদের সাথে পরিচয় হওয়ার বুঝলাম এই দেশে কেউ কাউকে ছোট চোখে দেখে না। সবাই একসাথে বসে গল্প করছে, কফি পান করছে। দ্বিতীয় কারণ ছিলো সাব গাড়ীর কারখানায় যে হারে বেতন পেতাম এখানেও ঠিক তাই।
(সুইডেনে একটি বিষয়ই অসহ্য ছিলো, কিছু লোকের রেসিজম)
পোষ্ট অফিসে কাজ করতে গিয়ে আবিস্কার করলাম, কারখানার কাজের চেয়ে এখানে কাজ করা অনেক সহজ। কারখানায় যেতে হলে আমাকে ৪টার আগেই ঘুম থেকে উঠতে হতো। তারপর দৌড়াতে হতো বাসষ্ট্যান্ডে। বাস, মেট্রো, ট্রেন, বাস – এভাবে পৌছাতে হতো কাজে। সারাদিন কাজ শেষে শরীরে মনে হতো আর কিছু নেই। বাসায় ফেরার পর আর কিছু করার ইচ্ছেই থাকতো না। জমানো কাজ করতে হতো উইকএন্ডে, মানে শনিবার / রবিবার। পোষ্ট অফিসে কাজ করতে গেলে উঠতাম ৬টার দিকে। ৮টার মধ্যে পৌছালেই হতো। তবে ১০টার মধ্যে ২ পোষ্ট অফিস কাভার করতে হলে বেশ দ্রুত কাজ করতে হতো। এক পোষ্ট অফিসের কাজ শেষ করে আরেকটায় যেতে হলে খূব সমস্যা হতো না। কারণ অফিস আওয়ারে বেশ ঘন ঘন বাস থাকে। এক বাস মিস করলে কিছুক্ষণের মধ্যেই পরবর্তী বাস পাওয়া যেতো। এই দুই পোষ্ঠ অফিসের কাজ শেষ করে পরবর্তী পোষ্ট অফিস দু’টিতে ধীরে সুস্থ্যে সময় নিয়ে কাজ করা যেতো। আর এই ৪ পোষ্ট অফিস ছিলো একই বাস রুটের মধ্যে। সকাল ১০ টার মধ্যে যে পোষ্ট অফিস দু’টিতে কাজ শেষ করতাম, পরবর্তী দিন সে দু’টিতে যেতাম ১০টার পর। বড় কাজগুলি করতাম ১০টার পর, যেমন পানি দিয়ে ফ্লোর ধোয়া, সাবান পানি দিয়ে বাইরের গ্লাস পরিস্কার করা। বাসে করে যাতায়াতের সময়টুকুও হিসাব করা হতো আমার কর্মঘন্টার ভিতর। কোন কোন মাসে দেখতাম আমার হিসাবে ওভারটাইমও যোগ হয়েছে। যদিও ওভারটাইম কিভাবে হিসাব করতো সেটা কোনদিনই বুঝি নাই।
কারখানায় কাজের বেতন সরাসরি জমা হতো ব্যাংক হিসাবে। পোষ্ট অফিসে সপ্তাহ শেষে চিঠি পেতাম বেতনের, সেটা যে কোন পোষ্ট অফিসে দিলেই ক্যাশ টাকা দিয়ে দিতো। পরে অবশ্য একটা সেভিংস একাউন্ট করেছিলাম পোষ্ট অফিসে। বেতনের টাকা সেখানেই জমা করতাম, কিছু রাখতাম হাতে। এদিয়ে টুকটাক কেনাকাটা, খাওয়া দাওয়া’র খরচ চলে যেতো। পকেটে কম টাকা রাখতাম, কারণ মার্কেটে গেলে কেবল হাত নিশপিশ করতো কিছু না কিছু কেনার জন্য। এই বদ অভ্যাস এখনও আছে। পকেটে টাকা নাই তো খরচও নাই।
পোষ্ট অফিসের কাজ শেষ করতে করতে ৪টা বাজতো। মাঝে মধ্যে দেখা যেতো ৩টার পরেই কাজ শেষ করে ফেলেছি। তখন হয়তো পোষ্ট অফিসের কারো সাথেই আলাপ শুরু করেছি। ৩-৪টার দিকে কাষ্টোমারও কম থাকতো। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ হতো। মূলত পোষ্ট অফিসে থাকাকালীন সময়েই আমি সুইডেন সম্পর্কে, সে দেশের মানুষ সম্পর্কে জানতে পারি সবচেয়ে বেশী। ওরাও বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চাইতো।
পোষ্ট অফিসে কাজ করার সময় দূপুরে একটা বড় সাইজের বার্গার খেতাম। সাথে হয়তো ক্যান কোক। কোন এক বাস ষ্টেশনের কাছাকাছি একটা বার্গারের দোকান ছিলো। টেক এওয়ে টাইপ। চশমা পরা এক ছেলে চালাতো। হঠাৎ করেই এই দোকানটা আবিস্কার করেছিলাম। প্রথমদিন ভীড় দেখে আর কিছু কিনি নাই। পরের দিন ভিন্ন এক সময়ে গিয়ে দেখি ফাঁকা। বার্গার আর হটডগ থাকতো, সাথে ক্যান অথবা গ্লাসের কোল্ড ড্রিঙ্ক। অর্ডার করার পর দেখা গেলো ফ্রিজ থেকে পেটি বের করে ভেঁজে নিয়ে আমার সামনেই বার্গার তৈরী করলো। ২৫ কিংবা ৩০ ক্রোণা ছিলো দাম। আমার জন্য খরচ একটু বেশী হলেও খাওয়ার পর বুঝলাম পয়সা উসুল। পরে মোটামুটি নিয়মিত এই দোকান থেকেই বার্গার অথবা হটডগ খেতাম।
ঠান্ডার দেশের লোক যে কেনো এই কোল্ড ড্রিঙ্ক আর আইসক্রিম খায়, সেটা এক বিস্ময়। আমার কাছে কোল্ড ড্রিঙ্ক ছিলো পানির বিকল্প। আর শীতের মধ্যে আইসক্রিম খাওয়ার অন্যরকম একটা মজা ছিলো। বাংলাদেশে তো আইসক্রিম ফ্রিজ থেকে বের হওয়ার পরই গলতে শুরু করে। ঐ দেশে শীতের সময় আইসক্রিম মোটামুটি শক্তই থাকে, সেটার মজা অন্যরকম। অনেকক্ষণ ধরে চেটে চেটে খাওয়া যায়।
একদিন ষ্টেশনে ঢুকবো, হাতে বার্গার। কয়েক কামড় খেয়েছি। এমন সময় এক ছেলে কোথা থেকে উড়ে এসে কি যেন বললো। প্রথমটায় একটু ভড়কে গিয়েছিলাম। বললাম ইংরেজীতে বলো। সে তখন বললো আমার হাতে বার্গার দেখে তার ক্ষুধা লাগতেছে। কিন্তু তার কাছে কোন টাকা নেই। খূব অবাক হয়েছিলাম তার কথায়। পকেট হাতরে ২০/২৫ ক্রোনা বের করে দিতেই সে বিশাল এক হাসি সহযোগে ধন্যবাদ দিলো। সুইডেনে যে এভাবে কেউ টাকা চাইতে পারে সেটি ছিলো ধারণারও অতীত। কাগজে কলমে ভিক্ষুক বলে কিছু না থাকলেও বাস্কার্স বলে একটা কথা আছে। এরা সাধারণত ট্রেন / মেট্রো ষ্টেশনে বেহালা / গিটার / একোর্ডিয়ান ইত্যাদি বাজায়, সামনে থাকে কোন বক্স বা টুপি। ভিক্ষাবৃত্তির পরিশীলিত রুপ। শুনেছিলাম ইউরোপে বাস্কিং নিষিদ্ধ, তবে কাউকেই কখনও ধরে নিয়ে গেছে এমন দেখিনি।
যাই হোক। বাসায় এসে রাতে খাওয়ার সময় বললাম আজ এক ইউরোপিয়ান ছেলেকে ভিক্ষা দিয়ে আসছি। আমার কথা শুনে সবাই যখন হাসতেছে তখন কাজিন বললো টাকাটা অপাত্রে গেছে। কারণ হলো এই দেশের লোক হাত পাতে কেবল মদ খাওয়ার জন্য। আমি তখন বাস্কার্সদের কথা জিজ্ঞেস করলাম। কাজিন বললো এরা অনেকেই টুরিষ্ট, পথের খরচ তোলার জন্য একম করে। ওর কাছে হয়তো টাকা আছে, ইমার্জেন্সির জন্য সেটা রেখে দিয়েছে। পথের টুকটাক খরচ হয়তো পথ থেকেই তুলে নেয়।
এভাবেই চলছিলো ষ্টকহোমের জীবন। দেখতে দেখতে জুন মাসের ছুটি শেষ হয়ে এলো। জুলাই থেকে শুরু হবে আবার সেই কষ্টকর কারখানার কাজ।
ফেসবুক মন্তব্য