জুলাই মাস যতোই নিকটবর্তী হতে থাকলো আমার টেনশন ততোই বাড়তে থাকলো। পোষ্ট অফিসের কাজ চালিয়ে যাবো নাকি ফিরে যাবো সাব ফ্যাক্টরীর কাজে। পরিশ্রম এর বিষয়টি ছাড়াও যে কোন সময় কোন দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার ভয় কাজ করছিলো অবচেতন মনে। পোষ্ট অফিসের কাজ যদিও সবাই’কে বলার মতো কিছু ছিলো না, তারপরও অনেকটা হেসে খেলে কাজ করা যেতো। আর বাসা থেকে খূব বেশী দূরেও ছিলো না। যদিও মরিস একবার বলেছিলো যে সোদাতালিয়ায় তার এক বিপত্নিক বন্ধু আছে, যে তার এপার্টমেন্টের এক রুম ভাড়া দিতে আগ্রহী। আমি ইচ্ছে করলে সেখানে থাকতে পারি কাজের দিনগুলোতে। উইকএন্ডে চাচার বাসায় এসে থাকলাম। অনেক কিছু বিবেচনা করে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে হয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত সেই মরিসের সাহায্যই নিতে হলো আবার। তাকে বললাম আমি পোষ্ট অফিসের কাজটাই চালিয়ে যেতে চাই, সাব এ ফিরতে চাই না। ওকে অবশ্য সব ব্যাখ্যা করে বললাম কেন ফিরতে চাই না। শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা হলো। জুলাই এর প্রথম দিন অবশ্য আমাকে ফ্যাক্টরীতে গিয়ে কাজ আরম্ভ করতে হয়েছিলো। লাঞ্চ এর আগে দিয়ে মরিস এসে আমাকে পিক করলো। রনি’র কাছে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়ার সময় দেখলাম বেচারা মুখ কালো করে আছে। হয়তো আমার জায়গায় আবার কাকে নিবে এই নিয়ে চিন্তা করছিলো। কাছাকাছি যে ২/৩ জন ছিলো তাদের’কে বিদায় জানিয়ে মরিসের সাথে রওনা হলাম। মরিস আমাকে ষ্টকহোম সেন্ট্রাল ষ্টেশনের কাছে নামিয়ে দিলো। পোষ্ট অফিসগুলিতে আগেই বলা ছিলো। আমি কোন রকমে সবগুলোতেই ঢু মেরে কোনরকমমে কাজ সারলাম।
কাজ করতে থাকলাম। পোষ্ট অফিসে মহিলারাই বেশী কাজ করে। পোষ্টম্যান ছাড়া আর মাত্র ৩ জন পূরুষ পেয়েছিলাম যারা পোষ্টাল অপারেটর হিসেবে কাজ করে। পোষ্টম্যানদের ভিতর আবার ৩জন মেয়ে ছিলো। এলতায় যে পোষ্ট অফিস ছিলো, সেটা একটু পুরাতন। আর এখান থেকেই এই এলাকার সব চিঠিপত্র বিলি হতো। বাকি ৩ পোষ্ট অফিস থেকে কোন চিঠিপত্র বিলি হতো না। সেখান থেকে কেবল চিঠিপত্র / পার্সেল এসব গ্রহন করা হতো, ষ্ট্যাম্প সহ অন্যান্য পোষ্টাল সামগ্রী বিক্রি হতো। আর ছিলো পোষ্টাল সেভিংস একাউন্ট। তবে সব পোষ্টঅফিসেই পোষ্টবক্স সার্ভিস ছিলো, তবে সেসব ছিলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য।
এই এলতা পোষ্ট অফিসেই জুলাই মাসে পরিচয় হলো উভে’র সাথে। একদিন সকালে গিয়েছি কাজে, পিছনের দরজার বেল বাজাতেই দরজার কাচের ছোট উইন্ডো’তে দেখা গেলো শশ্রুমন্ডিত এক মুখ। আগে কখনও দেখি নাই। সে হাত নেড়ে কি যেন বলতে চাইলো, বুঝি নাই। আমি হাত দিয়ে চাবি ঘোরানোর ভঙ্গি করলাম। এবার সে অল্প করে দরজা খুলুলে কি যেন বললো সুইডিশে। আমি তাকে ইংরেজীতে বললাম আমি এখানে কাজ করি, তোমাকে তো আগে দেখি নাই। এবার সে আমাকে অপেক্ষা করতে বলে কাকে যেন ডাক দিলো। এক পোষ্টম্যান আমাকে দেখেই কিছু একটা বললো। এবার পুরো দরজা খুলে দিলো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো তার নাম উভে। সে এখানকার পোষ্টম্যান। এই একমাস সে ছুটিতে ছিলো বলে পরিচয় হয় নাই। হ্যান্ড শেক করে আমিও আমার নাম বললাম। এবার উভে জিজ্ঞাসা করলো আমি কোন দেশের লোক। বললাম বাংলাদেশ। উভে একগাল হেসে জিজ্ঞাসা করলো তুমি কি সিলেটের লোক ? আমি পুরাই ব্যাক্কল হয়ে গেলাম। সুইডেনে বাংলাদেশ বললে অনেকেই চিনে না, এক মহিলা তো জিজ্ঞেস করেই ফেলছিলো বাংলাদেশ কি আফ্রিকায়। আর এই লোক দেখি সিলেট ও চিনে। আমি উভে’কে জিজ্ঞাসা করলাম সিলেট কিভাবে চিনো ? বাংলাদেশে গিয়েছিলে কখনও ? উভে হেসে বললো তার প্রতিবেশী বাংলাদেশী এবং তাদের বাড়ী সিলেটে। আমিও হাসলাম।
উভে’র সাথে যখন পরিচয় হলো তখন তার বয়স ৪৮ বছর আর আমার ২৪। দ্বিগুন বয়সের এই পোষ্টম্যানের সাথে খাতির জমতে বেশী দেরী হলো না। সুইডেন এবং সুইডিশদের সম্পর্কে জানা-শোনার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছিলো উভে। অনেক দিন তার সাথে হাটতে বের হয়েছি এলতা আর আশে-পাশের এলাকায়। আমাকে সে তার এক ফুটবল দলের সাথে নিয়ে গিয়েছিলো কাছের কোন এক শহরে টুর্নামেন্টের এক খেলা দেখতে। এক সাথে এক এমিউজমেন্ট পার্কে গিয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে পোষ্টঅফিসে কাজ করতে করতে উভে এবং অন্যান্যদের কাছ থেকেই সুইডিশ জীবনযাত্রার অনেক কিছুই জেনেছিলাম।
মাঝে মধ্যে উভে’র কথা এখনও মনে হয়।