কথা হচ্ছিলো সঞ্চয়পত্র নিয়ে। আমাকে বলা হলো সঞ্চয়পত্রের মুনাফা মানে সূদ, এটা হারাম। আরো বলা হলো মুনাফার হার যদি আগেই ঠিক (Fixed) করে দেয়া হয় তাহলে সেটা সূদ। লাভ / লোকসান সমান হারে বন্টন করলে সেট মুনাফা। আমি মেনে নিলাম। আমাকে বলা হলো সঞ্চয়পত্রে টাকা না রেখে অন্য কিছু করতে। আমি জানালাম এখন যে পরিস্থিতি তাতে অন্য কিছু করতে গেলে আম-ছালা দুই ই যাবে।
যাই হোক। কথা চললো আরো কিছুক্ষণ। এবার জানলাম পেনশনার সঞ্চয়পত্র অথবা পারিবারিক সঞ্চয়পত্র হলে ঠিক আছে। কারণ এটা সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে কেনা হয়। কিন্তু ৩ বছর মেয়াদী ৩ মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্র হারাম। এবার আমি বাক্যহারা।
বাংলাদেশীদের ধর্মজ্ঞান অতিমাত্রায় পরস্পর বিরোধী। সব সঞ্চয়পত্র একই, তাহলে একটার মুনাফা হালাল আরেকটার মুনাফা হারাম কেন হবে !?! সরকার তার বিভিন্ন খরচ মেটানোর জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে টাকা সংগ্রহ করে। তার মধ্যে সঞ্চয়পত্র অন্যতম। জনগনকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করার জন্য এখানে মুনাফা কিংবা সূদ যেটাই বলেন দেয়া হয়। এখন যদি সরকার বলে ক্ষতি হলে সেটাও বিনিয়োগকারীকে বহন করতে হবে তাহলে এক পয়সাও বিনিয়োগ আসবে না। আর সরকার তো সেই অর্থে ব্যবসা করে না। তারা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে ব্যয় করে।
এই গেলো প্রথম কথা। এবার আসি বাংলাদেশে যে সব ব্যাংক ইসলামী ধারার ব্যাংকিং করছে তারা কি করে সে বিষয়ে। বাংক যে আমানত সংগ্রহ করে তার বিপরীতে সূদ বা মুনাফা দেয়। আমানত সংগ্রহ করে তারা বিভিন্ন ব্যবসায় / শিল্প কারখানায় ঋণ দেয়। সেখান থেকে যা আয় হয় তার একটা অংশই আমানতকারীকে সূদ বা মুনাফা হিসেবে দেয়া হয়। এখন ইসলামী ধারার ব্যাংকি ব্যবস্থায় ঋণ না বলে বিনিয়োগ বলা হয়। এই বিনিয়োগের বিপরীতে সূদ নেয়া হয় না, নেয়া হয় সার্ভিস চার্জ এবং সেটির হার পূর্ব নির্ধারিত। ইসলামি মতে ব্যবসায় বিনিয়োগ করলে লাভ / ক্ষতি সমহারে বন্টনের কথা বলা হলেও এখানে সার্ভিস চার্জ এর গোলক ধাঁধাঁয় ক্ষতি বহনের কোন সূযোগ রাখা হয় নাই। আর আমানতকারীদের প্রতিবছর বোর্ড মিটিং করে ব্যাংকের লাভ / ক্ষতি বিবেচনা করে মুনাফা বন্টন করা হয়। এই হার কম-বেশী হয়। এখন আপনারাই বলেন ইসলামী ব্যাংকিং এর কথিত ‘সার্ভিস চার্জ’ যদি সূদ না হয় তাহলে সরকারী সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কেন সূদ হবে ? যেখানে সরকার সেই অর্থে ব্যবসা করছে না, জনগনের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ করছে। প্রণোদনা হিসেবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের একটা নির্দিষ্ট হারে মুনাফা দিচ্ছে।
সৌদি আরবের মতো মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোর কথা জানি না। তবে বাংলাদেশের মতো দেশে সূদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করা হয়তো কোনদিনও সম্ভব না। কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নেয়। তার জন্য তাকে নির্দিষ্ট হারে সূদ পরিশোধ করতে হয়। তারমানে এই দেশে জন্ম নিলে আপনি পরোক্ষভাবে সূদ দিতে বাধ্য।
স্ক্যান্ডেনেভিয়ার দেশগুলিতে অত্যন্ত উচ্চহারে আয়কর নেয়া হয়। যার আয় যত বেশী তার আয়করও বেশী। আয় কম হলে তার আয়করও কম। তবে ১৮ বছরের বেশী যে কোন নাগরিক এই আয়করের আওতায় আছে। এর ফলে ধনী আর দরিদ্রদের মধ্যে পার্থক্য খূবই কম। আর এই আয়কর দিয়ে সরকার তার জনগনের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা সূযোগ সূবিধা দিয়ে থাকে। যেমন ১৮ বছর পর্যন্ত ভাতা, বেকার থাকলে ভাতা, বিনামূল্যে শিক্ষা এবং চিকিৎসা (কিছু ক্ষেত্র বাদ দিলে), যাতায়াত ব্যবস্থায় ভর্তুকি ইত্যদি। আর বাংলাদেশে বর্তমানে ৮৮ লাখ মানুষের টিআইএন রয়েছে। তাদের মধ্যে আয়কর রিটার্নের প্রমাণ জমা দিয়েছেন ৩২ লাখ মানুষ। ১৬-১৮ কোটির এই দেশে এক কোটি লোকও করের আওতায় নাই। সুইডেনে বলা হয় কোন মানুষ খুন করলেও বিচারে আপনি ন্যুনতম শাস্তি পেতে পারেন। কিন্তু কর ফাঁকি দিয়ে আপনি পার পাবেন না। কারণ দেশের আপাময় জনসাধারণের সাথে আপনি প্রতারণা করেছেন।
হালাল খোঁজার এই দেশে ঘুষ-দূর্নীতি কোন পর্যায়ে সেটি বলাই বাহুল্য। ভারত থেকে গরু আমদানী না হলে কোরবানীর গরুর দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। আবার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানীর খবরে পেঁয়াজের দাম ঝপ করে ৩০/৪০ টাকা কমে যায়। কয়লা / গ্যাসের অভাবে বিদ্যুতের লোডশেডিং শুরু হলে চার্জার ফ্যানের দাম ৩ হাজার টাকা থেকে এক লাফে ৬ হাজার টাকা হয়ে যায়। হালাল খোঁজা আপনি হয়তো বলবেন ব্যবসা তো হালাল। কিন্তু গলায় পারা দিয়ে ব্যবসা করাও কি হালাল ? প্রতিটি রোজা, প্রতিটি ঈদে দেখা যায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে শুরু করে জামা কাপড় এমন কি লঞ্চ / বাসের টিকিটের দামও বেড়ে যায়। অথচ ক্রিসমাসে নন মুসলিম দেশগুলোতে জিনিসপ্রের দাম বরং কমানো হয়, যাতে সবাই নিজের নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কেনাকাটা করে আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে। আর এই দেশে এমনও ব্যবসায়ী আছেন যারা সারা বছরের ব্যবসা রোজার এই এক মাসে করেন।
অনেক কথা বলে ফেললাম। লেখাটি হওতো অগোছালো হয়ে গেছে। তবে সবশেষে আরেকটি কথা বলি। এটি একান্তই আমার ব্যক্তিগত মত। ইসলাম শুরু হওয়ার সময়ে সূদের ব্যবসা কেমন ছিলো আমার জানা নাই। তবে বর্তমানে অনেকেই ব্যক্তি পর্যায়ে ধার বা ঋণ দেয়ার ব্যবসা করেন। এসব ক্ষেত্রে সূদের হার অত্যাধিক। আমার এক কাজিন মুরগীর ফার্ম করেছিলো গাজীপুরে। চাচা পেনশনের টাকা দিয়ে জায়গা কিনেছিলেন। ফার্ম এর ক্যাপাসিটি বাড়ানোর প্রয়োজনে কাজিন স্থানীয় লোকের কাছ থেকে উচ্চ সূদে ঋণ নিয়েছিলো। সে আর ঠিকমতো দাঁড়াতে পারে নাই। লাগাতার ক্ষতির মূখে শেষ পর্যন্ত চাচা তার সেই জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। চাচাত ভাই কৃষিতে স্নাতক, শেষ পর্যন্ত এক কলেজে চাকরি নিয়ে এখন টিকে আছে। আমার ধারণা ইসলামে উচ্চ সূদে এই ধারের ব্যবসার বিরুদ্ধেই বলা হয়েছে। এখনকার ব্যাংক ব্যবস্থা নিশ্চয়ই উচ্চ সূদে ঋণ দেয় না। প্রয়োজনে সূদও মওকুফ করে।
ভাল থাকুন নিরন্তর।
ফেসবুক মন্তব্য