শুরু করি ছোটবেলায় শোনা দাদা’র এক কাহিনী দিয়ে। শুনেছিলাম দুর-সম্পর্কের এক দাদী (দাদার সম্পর্কীয় বোন) এর কাছ থেকে। আমার দাদা খূব অল্প বয়সেই মারা যান, তখন বাবা-চাচারাও একদমই ছোট ছিলেন, তারাও হয়তো দাদা-দাদীর চেহারা নিজেরাই মনে করতে পারেন না। আমাদের তাই দাদা-দাদী নিয়ে কোন স্মৃতি নেই। যা আছে সব শোনা কথার স্মৃতি।
দাদা ছিলেন ডাক্তার, এমবিবিএস ডাক্তার না। কলকাতা মেডিকেল স্কুল থেকে পাশ করা, তবে তার ডিগ্রি নিয়ে কিছুটা ধোয়াশা আছে। সেসময় বৃটিশ উপনিবেশ গুলিতে এলএমএস বলে ৫ বছরের একটি ডিগ্রি ছিলো। আর ছিলো এলএমএফ কোর্স। দাদা যে কোন কোর্স বা ডিগ্রি পাশ করেছিলেন সেটা এখন আর কেউ ঠিকমতো বলতে পারে না।
শোনা সেই কাহিনী বলি। দাদা ডাক্তারি করতেন একেবারে অজপাড়া গাঁয়ে। ব্রিটিশ আমলে তো যাতায়াত ব্যবস্থাও তেমন একটা ছিলো না। সে সময় কোন একদিন কোন এক গ্রামের কৃষক তার সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে আসলেন দাদার কাছে। কেমন করে নিয়ে এসেছিলেন সেটা আর জানা যায় নাই। ঘটনা হলো প্রসব বেদনা উঠার পর গ্রামের ধাত্রী দিয়ে প্রসব করানোর চেষ্টা করা হয়। গ্রামে-গঞ্জে তখন সেটাই রীতি। প্রসব করাতে গিয়ে কোন একটা ভজঘট বেঁধে গিয়েছিলো। বাচ্চা কিছুটা বের হয়ে আর বের হচ্ছিলো না। এই অবস্থায়ই কুষক তার স্ত্রীকে দাদার কাছে নিয়ে আসেন।
দাদা নিজেও চেষ্টা করলেন এবং ব্যর্থ হলেন প্রসব করাতে। এদিকে সময় যত যায়, স্ত্রী’র অবস্থা ততো খারাপ হয়। সবকিছু বিচার বিবেচনা করে দাদা কৃষকটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে কোন একজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। হয় বাচ্চা নয়তো কৃষকের স্ত্রীকে, দূ’জনকে বাঁচাতে গেলে হয়তো কাউকেই বাঁচানো যাবে না।
কৃষক নাকি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলেছিলো ‘গাছটাই রাখেন। গাছ থাকলে আমি ভবিষ্যতে ফল পাবো।”
গ্রামের ডাক্তারখানায় সেসময় আর কি থাকে – ঔষধপত্র, গজ-ব্যান্ডেজ আর হয়তো কিছু ছুরি-চিমটা এসব। দাদা সেই গ্রাম্য ডাক্তারখানায় শুরু করলেন এক অসম্ভব সার্জারি। অবশ্য সার্জারি বলা সঠিক কিনা আমি জানি না। হয়তো জীবন বাঁচানোর লড়াই বলাটাই শ্রেয়। একজন হয়তো টিকে যাবে, আরেকজন’কে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। তবে বেঁচে যাওয়া একজন শেষ অবধি টিকবে কিনা সেটাও জানা নেই।
দাদা প্রথমেই নাকি কোন এক ইঞ্জেকশন দিয়ে অনাগত শিশুটির হৃদস্পন্দন থামিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর … !!! একটু একটু করে কেটে বের করিছিলেন শিশুটিকে। হাত-পা-মাথা এবং পুরো শরীর, সবই বিচ্ছিন্ন হয়েছিলো ডাক্তারের ছুড়ির নিচে। একসময় থামলো এই ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়া। আশংকামুক্ত হয়েছিলো কৃষকের স্ত্রী।
এরপরের কাহিনী … দাদা ঘরের দরজা বন্ধ করে বসেছিলেন। কেউ তাকে ডেকেও বের করতে পারছিলেন না। থেমে থেমে শোনা যাচ্ছিলো তার কান্না আর চিৎকারের শব্দ। শেষ পর্যন্ত দাদার মা (বড় আম্মা) এসে অনেক সাধ্য সাধনা করে তাকে বের করতে পেরেছিলেন। কয়েকদিন নাকি পানি ছাড়া আর কিছু খাওয়ানো যায়নি তাকে। তিনি নাকি বার বার বলছিলেন ‘তিনি এক নিষ্ঠুর হত্যাকারী, এক শিশুকে জেনে-বুঝে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন।’
ভাল থাকুন, সুস্থ্য থাকুন। শরীরের যন্ত্ন নিন নীয়মিত।
ফেসবুক মন্তব্য