আলাপন ১৫-৬-১৮

জাকাত রঙ্গ

ঘটনাটা অনেক আগের। সদ্য কৈশোরর্ত্তীর্ণ এক তরকারীওয়ালার সাথে কথা হয়েছিলো। ছেলেটা দেখতে বেশ, কথাবার্তাও বেশ পরিস্কার, প্রায় শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে। তরকারী বিক্রি শেষে এক গ্লাস পানি খেতে চাইছিলো। তখনই আলাপ। ছেলেটা প্রথমে একটু লজ্জা পাচ্ছিলো। দু’একটা প্রশ্ন করার পর বেশ সহজ হয়ে গেল। ঢাকার কাছেই কোন এক /মফস্বল শহরে ওদের বাসা। তিন ভাই তিন বোন আর মা। শহরে তাদের একটুকরা জমি আছে, ২/৩ রুমের আধা পাকা টিন শেড একটা বাড়ীও আছে। হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারটিতে বিপর্যয় নেমে আসে। বড় বোনের বিয়ে হয়েছিলো আগেই। তার স্বামীও তাদের মতোই নিম্মবিত্ত। ছোট দুই বোন পড়ালেখা করতো।  কিন্তু অভাবের কারণে বন্ধ সেটা। বড় ভাই কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হীন। সারাদিন তবলীগ জামাতে পড়ে থাকে। মেঝ এই তরকারীওয়ালা। ছোট ভাইটা পড়তো। পড়া বন্ধ করে এক সাইনবোর্ডের দোকানে কাজ শিখছে। তাদের সেই জমি, বাড়ী আর কয়েকটা মৌসুমী ফলের গাছ ছাড়া কিছু নেই। বাবা মারা যাওয়ার পর মা তার দুই বোনকে নিয়ে সামান্য সেলাই এর কাজ করে কিছু আয়-ইপার্জনের চেষ্টা করছিলেন। ছেলেরাও তেমন কিছু করতে পারছিলো না। কারো কাছে হাত পাতার মতো সাহসও করতে পারছিলেন না। অবস্থা দিনে দিনে কেবল খারাপই হচ্ছিলো। একদিন এই মেঝ ছেলেটাই সাহস করে মায়ের কাছে কিছু টাকা চায় ঢাকা যাবে বলে। মা প্রথমে রাজী ছিলেন না। সামান্য কয়টাই টাকা আছে হাতে। এটা শেষ হলে কি হবে তিনি নিজেও জানেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছেলেটি তার মা’কে বুঝাতে পারে, ঢাকা আসে মাত্র ৮০০ টাকা সম্বল করে। মোহাম্মদপূরে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় সাময়িক ঠাই হয় তার।

কিন্তু চাকরি কি আর হাতের মোয়া যে চাইলেই হাতে নেয়া যায়। একে তো বয়স কম, তার উপর মাত্র ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশোনা। কে কি চাকরি দেবে এমন ছেলেকে কোন রেফারেন্স ছাড়া। যে বাসায় থাকে সে বাসার লোকজন ভালই, থাকা বা খাওয়া নিয়ে কোন কথা শুনতে হয় না। বাসার টুকটাক কাজগুলো তাই সে নিজ দায়িত্বেই করে দেয়ার চেষ্টা করে – এই বাজারটা করে দেয়া, বিল দিয়ে আসা, এটা-ওটা এনে দেয়া। ২/৩ মাস যাওয়ার পর বুঝতে পারে, চাকরি এতো সহজে হবে না। কিছু একটা করতে হবে তার – কিন্তু কি করবে। বাজার করতে গিয়ে দুই চারজনের সাথে আলাপ হয়েছে। একদিন সমস্ত লজ্জা ভেঙ্গে ফেলে তাদেরই একজন’কে বলে সে তরকারীর ব্যবসা করবে। মাথায় ঝাঁকা নিয়ে ঘুরবে পাড়ায় পাড়ায়। লোকটা মনে হয় ভালই ছিলো। কাওরান বাজারে নিয়ে গিয়ে সব চিনিয়ে দেয়। প্রথম প্রথম তিনিই সবকিছু কিনতেন, কেনা দাম ধরে ঝাঁকায় তুলে দিতেন ছেলেটার অংশ টুকু। এরপর দুপুর পর্যন্ত চলতো ঘোরাঘুরি। অনেক সময় বিক্রি হতো না সব, তখন আবার বাজারে সেই লোকের দোকানে বসেই বিক্রির চেষ্টা। আর যেদিন সব বিক্রি হয়ে যেতো সেদিন সেই দোকানীকেই কিছু সাহায্য করার চেষ্টা করতো ছেলেটি। একসময় আশ্রয়দাতার বাসায় জানালো কি করছে সে। প্রথমে সবাই একটু ভড়কে গেলে ও শেষ পর্যন্ত মেনে নিলো ব্যাপারটা। কারণ তারও তো কিছু করতে পারছিলেন না থাকা-খাওয়ার সূবিধা দেয়া ছাড়া। ছেলেটা এখন নিজের পছন্দ মতো তরকারী কিনতে পারে, বুঝতে পারে কোনটা চলবে আর কোনটা চলবে না। তবে সে সেই দোকানীর সাথেই সবকিছু করে। তার প্রাথমিক পূজি ছিলো ৩০০ টাকা, এখন সেটা হয়েছে ৫০০ টাকা। দিন শেষে কিছু টাকা থাকে বাড়তি (কতো লাভ হয় সেটা আমাকে বলেনি) সে টাকাটা সে জমিয়ে রাখে মায়ের জন্য॥ প্রতি মাসেই মাকে কিছু টাকা পাঠায়, ছোট ভাইটাও কিছু কিছু আয় করছে। এই হলো তরকারীওয়ালার গল্প।

আজ জাকাত নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে কিছু লোকের মারা যাওয়ার ঘটনা শুনে গল্পটা মনে পড়লো আবার। একটা শাড়ী বা একটা লুঙ্গী দিয়ে কি হয় একজন লোকের কিংবা ৫০ / ১০০ টাকা দিয়ে ? অথচ এই জাকাত দেয়া আর নেয়ার জন্য কি বিশ্রি একটা ঘটনা ঘটছে প্রতি বছর। কোন পক্ষেরই মনে হয় হুঁশ নাই। অথচ এই সব বিত্তবানরা চাইলেই হয়তো উপরের সেই তরকারীওয়ালা ছেলেটির মতো ২/৩ জন ছেলেকে প্রতি বছরই জাকাতের টাকা দিয়ে স্বাবলম্বি করে দিতে পারেন। একটা রিক্সা বা ভ্যান কিনে দিয়ে বা এরকম ছোটখাট কোন ব্যবসার পূঁজি (৫/১০/১৫ হাজার টাকা) যোগান দিয়ে। অনেকেই হয়তো বলবেন দিয়ে লাভ কি যদি বিক্রি করে দেয় বা নষ্ট করে টাকা। শাড়ী বা লুঙ্গী দিয়ে কি আপনি খোজ নেন সে কি করেছে সেটা দিয়ে , তাহলে এখানে রিক্সা নিয়ে কি করেছে বা টাকাটা নষ্ট করেছে কিনা সেটা নিয়ে আপনার চিন্তা করার দরকার কি। আপনি তো দানই করেছেন, ঋণ দেন নাই।

পত্রিকায় অনেকেই সাহায্যের জন্য আবেদন করে চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর জন্য। জাকাতের টাকার একটা সর্বোত্তম ব্যবহার হতে পারে এখানে। আপনি তো জাকাত দিতেনই, জনে জনে একটা শাড়ী বা লুঙ্গী বা ৫০ টাকা / ১০০ টাকা না দিয়ে এরকম এক দুই জনের চিকিৎসার ব্যয় দিয়ে দিলেন।  এমন কথা কি বলা আছে কোথাও যে জাকাতের ১০ হাজার টাকা একজনকে না দিয়ে ১০০ জনকে ১০০ টাকা করে দিলে বেশী সওয়াব পাওয়া যাবে ?

অনেকেই আছেন ঋণ নিয়ে আর শোধ দিতে পারছেন না। হয়তো স্ত্রী’র চিকিৎসা বা মেয়ের বিয়ের সময় টাকাটা ধার করেছিলেন। কিন্তু নানা চাপে এখন আর শোধ করতে পারছেন না। অথচ মানসিক অশান্তি আর মাঝে মাঝেই ঋণদাতার চোখ রাঙ্গানিতে অপদস্ত হতে হচ্ছে। এমন একজন মানুষ’কে কি ঋণমুক্ত করে শান্তিতে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দেয়া যায় না ?

এমন অনেক ছেলে মেয়ে আছে যারা পড়াশোনায় ভাল, কিন্তু পরিবারের অর্থনৈতিক দূরাবস্থার কারনে আগাতে পারছে না। বাধ্য হচ্ছে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে একটা যেন তেন চাকরি বা কাজ জুটিয়ে নিতে। অথচ এই সব বিত্তবানরা প্রতি বছর জাকাত দেয়ার নামে শাড়ী লুঙ্গী কিনে সবাইকে দেখিয়ে দান করার রঙ্গ করেন সেই টাকায় এমন অনেকেই শিক্ষা জীবন পূর্নতা পেতো। টাকাটা কেবল জলেই যাচ্ছে না, দেখিয়ে দান করার মানসিকতার কারণে মৃত্যু হচ্ছে কিছু মানব সন্তানের। ধর্মের নামে এরকম চরম অধর্ম মনে হয় আমাদের দেশেই কেবল সম্ভব।

এরকম শো অফ করার মানসিকতা বজায় থাকলে সে দিন মনে হয় আর দূরে না যখন সহস্তে দান করার দৃশ্য টিভিতে লাইভ দেখানো হবে আর আমরা অসহায় কিছু লোকের পদদলিত হয়ে মৃত্যুর দৃশ্যও লাইভ দেখবো বোনাস হিসেবে।

(পূর্বে প্রকাশিত)

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *