ক্যামেরা কথন – ৫

রেজিষ্ট্রেশন না হওয়ায় যে প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরছিলো এই ক্যামেরা কি আসলেই রিফার্বিশড, সেটা দিনে দিনে আরো প্রবল হচ্ছিলো। প্রায় একই সময়ে পরিচিত এক ফটোগ্রাফার ফ্লোরা লিমিটেড (নাইকন এর বাংলাদেশী ডিষ্ট্রিবিউটর) থেকে একই ক্যামেরা (ডি৩০০০) কিনেছিলো, তার ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখে আমার ধারণা আরো বেশী পোক্ত হয়েছিলো। ক্যামেরার এলসিডি স্ক্রিণে ছবির কালার দেখলেই পার্থক্য বুঝতে পারতাম কোন ঘাপলা আছে। সেই ফটোগ্রাফারের ক্যামেরায় কালার গুলি হতো চরম, আর আমারটায় কেমন যেন ফ্যাকাসে। কোন একবার এক গ্রুপের সাথে মানিকগঞ্জ গিয়েছিলাম ফটোওয়াকে। পথে ছিলো এক সরষে ক্ষেত। পথের পাশে গাড়ী রেখে সবাই নেমে গিয়ে বিভিন্নভাবে সেই সরষে ক্ষেতের ছবি তুলতে শুরু করলো। আমিও তুললাম কিছু। কয়েকজনের ছবিও দেখলাম ক্যামেরার এলসিডি’তে। সরষে ক্ষেত যারা দেখেছেন তারা জানেন ফুল এসেছে এমন ক্ষেতের রং কেমন হয়। ফুলের রং থাকে সবুজাভ হলুদ আর গছের নিচের অংশ সবুজ। যাদের ছবি দেখলাম সবার ছবিতেই এমনটি এসেছিলো। আর আমার ? একেবারে ফ্যাকাসে হলুদ। মনে হচ্ছিলো জন্ডিস কালার। আকাশের রং ও কেমন বিবর্ণ।

এ পর্যায়ে নেটে বিভিন্ন আর্টিকেল পড়তে শুরু করলাম এই রিফার্বিশ বিষয়ে। জানলাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রিফার্বিশড ক্যামেরা বিক্রি হয়, সেটা বলে-কয়েই। কিছু আছে অফিসিয়াল রিফার্বিশড ক্যামেরা, সেগুলো ম্যানুফ্যাকচারার নিজেই রিফার্বিশ করে। আপনি হয়তো ক্যানন বা নাইকনের ক্যামেরা কিনেছেন তাদের অফিসিয়াল ষ্টোর থেকেই। কিছুদিন ব্যবহার করেই সেটা ফেরত দিয়েছেন কোন কারণ ছাড়াই অথবা কোন প্রব এর কারণে। পৃথিবীর অনেক দেশেই ১৫-৩০ দিনের মানি ব্যাক গ্যারান্টি থাকে। সুতরায় কেনার পর এই সময়ের ভিতর জিনিস ফেরত দেয়া কোন ব্যাপার না। ফেরত আসার পর এই জিনিসগুলো ম্যানুফ্যাকচারার খূব ভালমতো টেষ্ট করে দেখে কোন কোন জায়গায় প্রব ছিলো। যদি কোন প্রব না থাকে তবে সেগুলো লিমিটেড ওয়ারেন্টি দিয়ে ‘ওপেন বক্স’ হিসেবে বিক্রি করা হয়।  মানে ক্রেতা জানছেন এই জিনিস আগে কেউ কিনে ফেরত দিয়েছে। তার লাভ হলো, একবারে নতুন (ইনট্যাক্ট বক্স) এর চেয়ে কম দামে জিনিসটা সে কিনতে পারলো।

যেসব জিনিস প্রব এর কারণে ফেরত আসে, সেগুলো খূব ভালমতো চেক করার পর প্রয়োজনীয় পার্টস ইত্যাদি পরিবর্তন করে রিফার্বিশড হিসেবে বিক্রি করা হয়। সেখানেও ৩-৬ মাসের লিমিটেড ওয়ারেন্টি থাকে। এক্ষেত্রে সাধারণত রেগুলার বক্স এর বদলে ভিন্ন রং এর বক্স ব্যবহার করা হয়। সোজা কথা রিফার্বিশড বলেই সেগুলো বিক্রি হয়, নতুন বলে কেউ বিক্রি করে না এবং কারো প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

রিফার্বিশড ক্যামেরা বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে আরো কিছু বিষয় জানা গেলো। অন্যতম হলো শাটার কাউন্ট। শাটার কাউন্ট কি ? সোজা বাংলায় আপনি এক একটি ছবি তুলছেন সেটিই এক একটি শাটার কাউন্ট। আপনি শাটার টিপছেন, ক্যামেরার ভিতরে হয়তো কিছু কলকব্জা নড়াচড়া শুরু করেছে সাথে সাথেই। ভিতরে আলোর হিসাব নিকাশ হয়ে গেলো মুহুর্তেই, এরপর মিররটি উঠে গেলো উপরে। এপারচার সেট হয়ে গেলো আর শাটার কার্টেন উঠে গিয়ে আলো প্রবেশের পথ করে দিলো। সেন্সর সেই আলো রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিলো পরবর্তী ধাপে। এর মধ্যে শাটার কার্টেন নেমে এসেছে আর মিররও ফিরে এসেছে আগের জায়গায়। আপনার শাটার টেপা থেকে শুরু করে ছবি প্রসেস হয়ে মেমরি কার্ডে সেভ হওয়া – হয়তো সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যেই কাজটি হয়ে গেছে, কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটিই জটিল এক ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল সিস্টেম। মিরর আর শাটারের উঠা-নামা অনেকাংশে যান্ত্রিক, বাকি সব ইলেক্ট্রনিক্স। এখন কথা হলো প্রতিটি যন্ত্রেরই একটি লাইফ সাইকেল থাকে। তাই প্রতিটি ম্যানুফ্যাকচারার হিসাব করেই ১ বছর / ৫ বছর ওয়ারেন্টি দেয়। এর বাইরে আরেকটি হিসাব থাকে যেটি কেউ জানে না – কতদিন যন্ত্রটি চলবে। ১৯৬৮ সাল আর ১৯৭০ সালে কেনা  ফ্রিজ এবং টিভি আমাদের বাসায় ছিলো ৮০’র দশকের প্রায় শেষ পর্যন্ত। মোটামুটি ১৫+ বছর সার্ভিস দিয়েছিলো যন্ত্রগুলি।

ক্যামেরা কতদিন টিকে বা টিকবে ? ম্যানুফ্যাকচারারদের অলিখিত হিসাব হলো ক্রপড ফ্রেম ডিএসএলআর এর স্বাভাবিক আয়ূ ১.৫ লক্ষ শাটার কাউন্ট আর ফুলফ্রেম ডিএসএলআর এর ৫ লক্ষ শাটার কাউন্ট। তার মানে এই না যে ১.৫ / ৫ লক্ষ শাটার কাউন্ট এর আগে কোন ক্যামেরা নষ্ট হবে না বা এরপরই ক্যামেরা ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে যাবে। ব্যবহারের উপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। আপনি নেটে রিফার্বিশড / শাটার কাউন্ট এসব নিয়ে যদি একটু ঘাটাঘাটি করেন তবে অনেক মজার মজার কাহিনী পাবেন। এক ভদ্রলোকের কাহিনী মনে পড়ছে। ক্যামেরা কেনার কিছুদিন পরেই তার ক্যামেরার শাটার ফেইল করে, মানে শাটার টিপলেও কোন কিছু নড়ছিলো না, ছবিও উঠছিলো না। পরে দেখা গেলো তার মিরর এর একটা মেকানিজম কোন কারণে আটকে গেছে। সেটা ঠিক করতেই আবার ক্যামেরা সচল হয়েছিলো। আরেকজনেরও একই সমস্যা। অথোরাইজড সার্ভিস সেন্টারে দেয়ার পর তারা শাটারের পুরো মেকানিজম পরিবর্তন করার জন্য বড় একটা সার্ভিস চার্জ দাবি করেছিলো। ভদ্রলোক ক্যামেরা ফেরত নিয়ে এসে নিজেই নিচের অংশ খুলে দেখেন সেখানে কোন কারণে মেকানিজমটি ঘুরছে না। তিনি তার কাছে থাকা টুলস দিয়ে সেই মেকানিকজম (খাঁজ কাটা চাকা) ঘুরাচ্ছিলেন আর ভিতরে থাকা গ্রিজ ইত্যাদি পরিস্কার করছিলেন। একসময় পুরোটা পরিস্কার হওয়ার পর তার ক্যামেরা আবার সচল হয়েছিলো। এরকম অনেক কাহিনী আছে। ১.৫/৫ লক্ষ শাটার কাউন্ট পার হওয়ার পর ক্যামেরা সচল আছে এমন অনেক কাহিনীও আছে। সেসময় হয়তো ছবির মান ততোটা ভাল ছিলো না। সেন্সর হয়তো আগের কোয়ালিটি ধরে রাখতে পারছিলো না।

এবার আসি আসল কথায়। অফিসিয়ালি যখন ক্যামেরা রিফার্বিশড করা হয় তখন কাজ শুরুর আগে তার শাটার কাউন্ট লিখে রাখা হয়। কাজ শেষ করার সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে ক্যামেরার ফার্মওয়্যার রি ইন্সষ্টল করা। আর তখন শাটার কাউন্ট ০ হয়ে যায়। এরপর লিখে রাখা শাটার কাউন্ট সেট করে দেয়া হয় রিফার্বিশড ক্যামেরায়। এর মানে হলো আপনি যখন অফিসিয়ালি রিফার্বিশড ক্যামেরা কিনবেন তখন আপনি চেক করলেই জানবেন এই ক্যামেরায় এত গুলি ছবি তোলা হয়েছে।

ফার্মওয়্যার রি ইন্সষ্টল করলে শাটার কাউন্ট ০ হয়ে যায় – এই বিষয়টির সূযোগ গ্রহন করে অসাধূ ব্যবসায়ীরা। ডিএসএলআর ক্যামেরার মতো হাই টেক জিনিস ঘরে বসে বানানো (মানে নকল করা) সম্ভব না। বানাতে হলে ক্যানন / নাইকনের মতোই কারখানা লাগবে। তাই তারা ব্যবহৃত ক্যামেরাই ধূয়ে মুছে পরিস্কার করে, প্রয়োজনে এক-আধটা পার্টস পরিবরতন করে ফার্মওয়্যার রি ইন্সষ্টল করে নতুন বলে চালিয়ে দিচ্ছে। আপনার ধরার কোন উপায়ই নাই। আপনি বড়জোর ম্যানুফ্যাকচারার এর সাইটে রেজিষ্ট্রেশন করতে না পারলে আমার মতো সন্দেহের দোলায় দুলবেন।

আজ এই পর্যন্তই। মনে করে অবশ্যই নতুন কেনা ক্যামেরা / লেন্স রেজিষ্ট্রেশন করবেন। তাতে যে কেবল আপনি কনফার্ম হবেন আপনার কষ্টের টাকায় কেনা জিনিসটি অরিজিনাল, সেই সাথে এসব চুরি / ছিনতাই হলে অন্য কেউ এগুলো আর রেজিষ্ট্রেশন করতে পারবে না। নিজে সচেতন হোন, অন্যকে সচেতন করুন।

হ্যাপি ক্লিকিং

Featured Image : নাইকন ডি৩০০০ ক্যামেরা আর এএফএস ৫৫-২০০ মিমি লেন্সে তোলা ছবি। এফ/৮, শাটার স্পিড ১/২৫০, আইএসও ১০০
মূল ছবি এখানে। ছবিতে সর্ষে ক্ষেতের যে রং দেখছেন সেটি এপর্যায়ে আনা হয়েছে ফটোশপ দিয়ে।

 

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।