কেভিন কার্টার

সেদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছিলাম আলোর ইশকুলের ১১তম ব্যাচের উদ্বোধন এবং পরিচিতি অনুষ্ঠানে। আমি সেই ব্যাচের একজন প্রশিক্ষণার্থী। উদ্বোধনী বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশি পাখি বিশেষজ্ঞ, আলোকচিত্রী, লেখক ও পর্যটক জনাব ইনাম আল হক। অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক সচিব জনাব শামীম আল মামুন। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন কোর্সের অন্যতম শিক্ষক আলোকচিত্রী জনাব কে এম জাহাঙ্গীর আলম। সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন কোর্সের পরিচালক জনাব মীর শামছুল আলম বাবু।

জনাব শামীম আল মামুন তাঁর বক্তব্যের একপর্যায়ে একজন ফটোগ্রাফারের নাম বলেন যিনি সাউথ আফ্রিকান এবং পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁর ছবির জন্য। দুঃখজনকভাবে এই পুরস্কার পাওয়ার কয়েক মাস পর তিনি আত্মহত্যা করেন। নাম শুনে আমার মনে হচ্ছিলো আমি এই নাম আগেও শুনেছি, কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছিলাম না। সমস্যা হলো বাসায় এসে নামও পুরোপুরি মনে আসছিলো না। বয়সের সমস্যা, কি আর করা। আমার কেবল মনে ছিলো “কার্টার” — আমি গুগলে সার্চ দিলাম carter photographer south africa লিখে। গুগল নিঃসন্দেহে আমার চাইতে স্মার্ট। সে নিমেষেই আলোকচিত্রী কেভিন কার্টার বিষয়ে সব তথ্য হাজির করলো। তথ্য পড়ার আগেই আমার চোখ আটকে গেলো একটি ছবিতে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি শকুন বসে আছে, তার সামনে একটি শিশু। শিশুটি হয়তো জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত, আর শকুনটি যেন অপেক্ষা করছে শিশুটির শেষ পরিণতির জন্য। আমার মনে পড়লো— এই ছবিটি আমি আগেও দেখেছিলাম এবং সেই কেভিন কার্টার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছিলাম।

The Vulture and the Little Girl, by Kevin Carter
The Vulture and the Little Girl, by Kevin Carter

ফটোগ্রাফি কখনও কখনও শুধু আলোর খেলা নয়, বরং জীবনের নির্মম বাস্তবতার আয়না। দক্ষিণ আফ্রিকার চিত্রসাংবাদিক কেভিন কার্টার (Kevin Carter) সেই আয়নারই এক সাহসী ও বেদনাভরা প্রতিচ্ছবি। ১৯৬০ সালে জোহানেসবার্গে জন্ম নেওয়া এই ফটোগ্রাফার বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসেন একমাত্র একটি ছবির জন্য— “The Vulture and the Little Girl”। কিন্তু সেই ছবিই শেষ পর্যন্ত তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।

১৯৯৩ সালে, সুদানের দুর্ভিক্ষকবলিত এলাকায় কার্টার এক অপুষ্ট ছোট শিশুর ছবি তোলেন, যার পেছনে একটি বিশাল শকুন অপেক্ষা করছে। ছবিটি প্রকাশিত হওয়ার পর সারা বিশ্ব কেঁপে ওঠে। কেউ শিশুটির দুর্দশায় কাঁদলেন, কেউ আবার প্রশ্ন তুললেন— ফটোগ্রাফার হিসেবে কার্টার কেন শিশুটিকে সাহায্য করলেন না? মানবিকতা বনাম সাংবাদিকতার নৈতিক সীমারেখা নিয়ে শুরু হয় তীব্র বিতর্ক।

১৯৯৪ সালে এই ছবির জন্য কেভিন কার্টার Pulitzer Prize অর্জন করেন। কিন্তু পুরস্কারের আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মানুষ তাঁকে নায়ক বলার পাশাপাশি নির্মম দর্শক হিসেবেও অভিযুক্ত করতে থাকে। মিডিয়ার চাপ, সামাজিক সমালোচনা আর নিজের ভিতরের অপরাধবোধ মিলে কার্টারের জীবনকে বিষিয়ে তোলে। তিনি বারবার বলেছিলেন, “আমি ছবিটি তোলার পর শকুনটিকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম”, কিন্তু ততদিনে বিশ্ব তাঁর নৈতিকতা নিয়ে রায় দিয়ে ফেলেছিল।

আসলে কেভিন কার্টারের জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ছিল নিজের সঙ্গে। দক্ষিণ আফ্রিকার “Bang-Bang Club”-এর সদস্য হিসেবে তিনি বছরের পর বছর ধরে হত্যাযজ্ঞ, গুলিবর্ষণ, দাঙ্গা আর মৃত্যু দেখেছেন খুব কাছ থেকে। এই দৃশ্যগুলো তাঁর মানসিক অবস্থাকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। একসময় তিনি বিষণ্ণতায় ভুগতে শুরু করেন, এবং ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে নিজের গাড়ির ভিতরে আত্মহত্যা করেন।

তাঁর রেখে যাওয়া আত্মহত্যার নোটে লেখা ছিল—
“আমি হত্যাকাণ্ড, মৃতদেহ, যন্ত্রণা ও ক্ষুধার্ত শিশুদের স্মৃতি থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। আমি আর পারছি না।”

এই কয়েকটি বাক্য যেন এক যুদ্ধফটোগ্রাফারের অন্তরের চিৎকার। কেভিন কার্টারের জীবন ও মৃত্যু আমাদের শেখায়— ক্যামেরার পেছনে থাকা মানুষটিরও অনুভূতি, ভয় ও যন্ত্রণা থাকে। তিনি শুধু ঘটনাকে ধারণ করেন না, তার ভারও বহন করেন নিজের ভিতরে।

আজ তাঁর তোলা সেই একটি ছবিই ইতিহাস হয়ে আছে— মানবতার প্রতীক হিসেবে, আবার বিতর্কের প্রতীক হিসেবেও। কেউ বলেন, সেটি বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া এক সততার প্রতিচ্ছবি; কেউ বলেন, সেটি নৈতিকতার ব্যর্থতার উদাহরণ। কিন্তু যেভাবেই দেখি না কেন, কেভিন কার্টার প্রমাণ করে গেছেন— একটি ছবি কখনও কখনও পুরো পৃথিবীর বিবেককে জাগিয়ে দিতে পারে।

Photo credit : The Vulture and the Little Girl by Kevin Carter
তথ্য : গুগল / চ্যাটজিপিটি 

কেভিন কার্টার এবং আরো ৩ জন যুদ্ধ ফটোগ্রাফার (War / Conflict Photographer) এর লাইফ এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে The Bang Bang Club নামে একটি চলচ্ছিত্র নির্মিত হয়েছিলো। দেখতে পারেন

 

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।