বাবরী মসজিদ

বাবরী মসজিদ নিয়ে মামলার রায় হয়ে গেলো আজ (৯ই নভেম্বর, ২০১৯)। বহু বছর (১৮৫৩ সাল থেকে) ধরে এই এই মসজিদ নিয়ে হিংসা-বিদ্বেষ চলে আসছিলো। বাবরী মসজিদ তৈরী করা হয় ১৫২৮ সালে, তখন থেকেই হিন্দুরা দাবী করতে থাকে যে তাদের অন্যতম আরাধ্য দেবতা রামের জন্ম হয়েছিলো যে স্থানে সেখানেই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে।

১৮৫৩ সালে প্রথম এই মসজিদ’কে ঘিরে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। তখন শাসন ক্ষমতায় ছিলো ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তারা দুই সম্প্রদায়ের মানুষের আরাধনার জায়গা পৃথক করার জন্য একটি বেষ্টনি তৈরী করে দেয়। বেষ্টনির ভিতরের চত্বর মুসলিমদের জন্য এবং বাইরের চত্বর হিন্দুদের জন্য নির্ধারিত হয়। হিন্দুদের জন্য নির্ধারিত অংশে একটি কাঠের প্ল্যাটফর্মের উপর শিশু রামের একটি প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়। মুসলিমরা তাদের জন্য নির্ধারিত বাবরী মসজিদেই প্রার্থনা করতেন। পরবর্তী ৯৬ বৎসর এভাবেই চলছিলো।

১৯৪৭ সালে বৃটিশরা যখন ভারতীয় উপমহাদেশ ভারত এবং পাকিস্থান দুই অংশে ভাগ করে ফিরে যায়, শুরু হয় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। সেসময় আবারও এটিকে রাম জন্মভূমি ঘোষণার জন্য দাবী উঠতে থাকে। সেই সাথে সেখানে একটি রাম মন্দির স্থাপনের দাবীও করা হয়। ১৯৪৮ সালে ফৈজাবাদের জেলা প্রশাসক এটিকে বিতর্কিত ভূমি হিসেবে ঘোষণা করেন। একই সাথে বাবরী মসজিদে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। দুইজন প্রহরীর উপর দায়িত্ব দেয়া হয় পাহারা দেয়ার, যাদের একজন হিন্দু এবং অন্যজন্য মুসলিম। ২২-২৩শে ডিসেম্বর, ১৯৪৯ সালের রাত্রের যে কোন একসময় মসজিদের ভিতরে রামের মূর্তি পাওয়া যায়। মুসলিমরা এর জন্য হিন্দুদের দায়ী করে, কিন্তু হিন্দুদের দাবী ছিলো এটি অলৌকিক ঘটনা। তারা এটিকে রামের জন্মভূমির স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে প্রচার করতে থাকে। কয়েকদিনের মধ্যেই এই খবর ছড়িয়ে পরে এবং রাম ভক্তরা অযোধ্যায় ছুটে আসতে থাকেন।

১৯৫০ সালে প্রথম এই ইস্যু নিয়ে আদালতে মামলা করেন গোপাল সিং বিশারদ। দ্বিতীয় মামলাটি হয় ১৯৫৯ সালে নির্মহিয়া খারা। ডিসেম্বর ১৯৮১ সালে সুন্নী ওয়াকফ বোর্ড আরেকটি মামলা করে।

ফেব্রুয়ারী ১৯৮৬ সালে রাজীব গান্ধী সরকার উত্তর প্রদেশ প্রাদেশিক সরকার’কে বাবরী মসজিদের তালা খুলে দেয়ার জন্য প্রয়োজনীন ব্যবস্থা নিতে বলেন। তাদের ধারণা ছিলো এতে হিন্দুরা শান্ত হবে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে না। ফৈজাবাদ জেলা আদালত তালা খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন। কথা ছিলো একজন ঠাকুর বছরে একা একবার এই স্থানে পূজা দিবেন, কিন্তু তালা খুলে দেয়ার পর দেখা গেলো এটি রাম ভক্তদের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে।

পহেলা জুলাই ১৯৮৯ সালে ভগবান রামের নামে এই মসজিদ কমপ্লেক্সটিকে রামের জন্মভূমি ঘোষণার দাবিতে মামলা করা হয়। এরপর ৪ মামলাকে একসাথে করে এলহাবাদ হাইকোর্টে একটি বিশেষ বেঞ্চে স্থানান্তর করা হয়।

একবছর পর বিজেপি নেতা এল কে আদভানীকে গ্রেফতার হন তার ২৮ দিনের রথযাত্রার সময়। বলা চলে এরপরই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আয়ত্বের বাইরে চলে যায়।

১৯৯১ সালে উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। আর পরই ১৯৯২ সালে ভিএইচপি, বিজেপি এবং শিব সেনা পার্টির সমর্থকরা মসজিদটি ধ্বংস করে। এর ফলে পুরো ভারতে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে দাঙ্গায় ২ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। 

২০০২ সালে হিন্দু তীর্থযাত্রী বহনকারী একটি ট্রেনে হামলায় ৫৮ জন মারা যান। ট্রেনে হামলার জের ধরে গুজরাটে ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয় এবং তাতে প্রায় ২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

২০০৩ সালে বিতর্কীত ভূমিতে রাম মন্দির ছিলো কিনা জানার জন্য নৃতত্ত্ববিদরা জরীপ শুরু করেন।

আগষ্ট ২০০৩ সালে জরিপে প্রকাশিত হয় যে মসজিদের নিচে পুরাতন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে যা ইসলামিক নয়, কিন্তু মুসলিমরা এই দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। 

জুলাই ২০০৫ সালে সন্দেহভাজন ইসলামি জঙ্গীরা বিস্ফোরক ভর্তি একটি জিপ দিয়ে বিতর্কিত স্থানটিতে হামলা চালিয়ে সেখানকার চত্বরের দেয়ালে গর্ত তৈরি করে। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী’র হাতে নিহত হয় ছয়জন, যাদের মধ্যে পাঁচজনই জঙ্গি বলে দাবি করে নিরাপত্তা রক্ষীরা। 

জুন ২০০৯ সালে মসজিদ ধ্বংস হওয়া সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে থাকা লিবারহান কমিশন তদন্ত শুরু করার ১৭ বছর পর তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রকাশিত লিবারহান কমিশনের প্রতিবেদনে মসজিদ ধ্বংসের পেছনে বিজেপি’র শীর্ষ রাজনীতিবিদদের ভূমিকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।

সেপ্টেম্বর ২০১০ সালে এলহাবাদ হাইকোর্ট রায় দেয় যে স্থানটির নিয়ন্ত্রণ ভাগাভাগি করে দেয়া উচিত। কোর্টের রায় অনুযায়ী এক-তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রণ মুসলিমদের, এক-তৃতীয়াংশ হিন্দুদের এবং বাকি অংশ ‘নির্মোহী আখারা’ গোষ্ঠীর কাছে দেয়া উচিত। যেই অংশটি বিতর্কের কেন্দ্র, যেখানে মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল, তার নিয়ন্ত্রণ দেয়া হয় হিন্দুদের কাছে। রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষই আপিল করায় এলহাবাদ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট।

৯ই নভেম্বর ২০১৯ সালে রায়ে বলা হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরী মসজিদের জায়গাটি পাবে হিন্দুরা। মুসলমানদের জন্য অন্য কোথাও ৫ একর জাগয়া বরাদ্দ দিতে নির্দেশ দেয়া হয়।

আরো বিস্তারিত জানতে নিচের লিংকগুলি ভিজিট করতে পারেন।
১. বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির বিতর্ক: ফিরে দেখা ইতিহাস – বিবিসি
২. Ram Janmabhoomi-Babri Masjid dispute: The full story – India Today

বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার পর রাজাকার মাওলানা মান্নানের পত্রিকা দৈনিক ইনকিলাব সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়িয়ে দিয়েছিলো। তাতে ঢাকা সহ সারা দেশে হিন্দুদের সম্পত্তি এবং ব্যবসা কেন্দ্রে ব্যাপক ভাঙ্গচুর করে ক্ষতিসাধন করা হয়। এবারেও যাতে সেরকম কোন ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে আশা করি সবাই সচেতন থাকবেন।

ভাল থাকবেন নিরন্তর।

ছবি : আনন্দবাজার পত্রিকা

 

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।