বাংলাদেশ বেতার লোগো

বাংলাদেশ বেতার

বাংলাদেশ বেতারের প্রথম ও প্রাচীন ঢাকা কেন্দ্র ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র নামে সম্প্রচার শুরু করে। নাজিমউদ্দীন রোডের যে বাড়িতে বর্তমানে শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজ অবস্থিত সে বাড়িটি ভাড়া করে ব্রডকাস্টিং হাউজ তৈরি করা হয়েছিল। কল্যাণপুরে পাঁচ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটারটির প্রচার সীমা দিনে ২০ থেকে ২৫ মাইল এবং রাতে ৩০ থেকে ৪৫ মাইল বিস্তৃত ছিল। বর্তমানে ট্রান্সমিটারটি বেতারের যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ঢাকা বেতার অল ইন্ডিয়া রেডিওর ঢাকা কেন্দ্র হিসাবে এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হতে থাকে। ঢাকা বেতারের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন বহু শিল্পী কবি লেখক সাহিত্যিক সাংবাদিক নাট্যকার গীতিকার সুরকার কথক উপস্থাপক গায়ক গায়িকা যন্ত্রশিল্পী ও অভিনেতা অভিনেত্রী। কলকাতা বেতারের বিখ্যাত শিল্পীরা ঢাকায় অতিথি শিল্পী হিসেবে অনুষ্ঠান করতেন।

নাজিমউদ্দীন রোডের ব্রডকাস্টিং হাউজের স্টুডিও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছিল না। এমনকি রেকর্ডিং এর জন্য শব্দধারণ যন্ত্রও ছিল না ঢাকায়। তাই শিল্পীদের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারিত হতো। ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত দুটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান ছিল প্রমথেশ বড়ুয়া ও যমুনা দেবী অভিনীত নাটক দেবদাস এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সুরারোপিত ও পরিচালিত সঙ্গীতালেখ্য পূর্বাণী। ঢাকা কেন্দ্রের অধিবেশন চলত বিকেল পাঁচটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত।

দেশ বিভাগের পর ঢাকা বেতার প্রথমে পাকিস্তান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস এবং পরে রেডিও পাকিস্তানের একটি স্টেশন হিসেবে পরিচালিত হতে থাকে। করাচি থেকে রেডিও সিগন্যাল পুনঃসম্প্রচারের লক্ষ্যে বোর্ড বাজার, গাজীপুরে গড়ে তোলা হয় একটি কারিগরি মনিটরিং কেন্দ্র। ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে দুটি এক কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ এবং ১৯৫৯ সালে কল্যাণপুরে ১০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয়। ততোদিনে অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি ভারতের শিল্পী ও কুশলীদের শূন্যতা দক্ষতার সাথে পূরণ করেন। ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বেতার শাহবাগে ৬টি স্টুডিও বিশিষ্ট আধুনিক ব্রডকাস্টিং হাউজে স্থানান্তরিত হয়। সেই ব্রডকাস্টিং হাউজ বর্তমানে শাহবাগের বেতার সদর দপ্তর। এখানে ১২টি স্টুডিওর মাধ্যমে প্রতিদিন সকাল ৬ টা থেকে রাত আড়াইটা পর্যন্ত বাণিজ্য বহির্বিশ্ব ট্রান্সক্রিপশন ও ট্রাফিক সম্প্রচারসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার ধারণ সম্পাদনা ও সংরক্ষণ করা হতো।

১৯৬১ সালে সিলেট কেন্দ্রে দুই কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে সাভারে ১০০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ও একটি ১০০ কিলোওয়াট শর্ট ওয়েভ ট্রান্সমিটার স্থাপিত হলে ঢাকার সম্প্রচার সীমা আরো বিস্তার লাভ করে। একই বছরে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বেতারের পুরাতন ট্রান্সমিটারগুলির বদলে ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয়। ১৯৬৭ সালে রংপুর ও সিলেট এবং ১৯৭০ সালে খুলনা বেতার কেন্দ্রে ১০ কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার সংস্থাপিত হয়। এই সকল আঞ্চলিক বেতার কেন্দ্র পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও লোকজ ধারাকে সংরক্ষণ ও সমুন্নত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এতে বেতার অনুষ্ঠানের ধরন ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়। বেতারের অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় জাতীয় উন্নয়ন ইস্যুগুলি গুরুত্ব পেতে থাকে। কৃষি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা পল্লি উন্নয়ন স্বকর্মসংস্থান পরিবেশ প্রকৃতি ও শিশুবিষয়ক অনুষ্ঠান শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঢাকা বেতারের বাষট্টি বছরের পুরনো কৃষি অর্থনীতি বিষয়ক ‘আমার দেশ’ অনুষ্ঠান এখনও সম্প্রচারিত হচ্ছে।

সূচনাপর্ব থেকেই বেতার সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে স্বল্পমূল্য, সহজে বহনযোগ্যতা ও বিষয়বস্তুর সাবলীল উপস্থাপনের গুণে তথ্য, শিক্ষা ও বিনোদনের প্রধান উৎসে পরিণত হয়। আঞ্চলিক বেতার কেন্দ্রগুলির শ্রোতাবৃন্দ নিজেদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে ছাত্র জনতার উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে বেতারের স্টাফ আর্টিস্টরা ২১ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠান সম্প্রচারে বিরত থাকে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ভাষণ বেতারে প্রচারে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে বেতারের কর্মকর্তা কর্মচারী শিল্পী ও কুশলী রাজপথে নেমে আসে। পরদিন সকালে পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচারে সম্মত হলে বেতারকর্মীরা পুনরায় বেতার কেন্দ্র চালু করে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করলে চট্টগ্রাম বেতারকর্মীরা পরদিন চট্টগ্রাম কেন্দ্রকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র হিসেবে অভিহিত করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্প্রচার করে। মুক্তিযুদ্ধ এগিয়ে নিতে ২৫ মে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার শুরু হয় এবং প্রবাসী সরকার ডিসেম্বরে ঢাকায় ফিরে এলে এই কেন্দ্রের সমাপ্তি ঘটে। এই পর্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ৬টি আঞ্চলিক বেতার কেন্দ্র অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে।

স্বাধীনতার পর ঢাকা বেতার আঞ্চলিক কেন্দ্র থেকে জাতীয় স্টেশনে উন্নীত হয়। জাতির প্রয়োজনে নতুন নতুন অনুষ্ঠান প্রণয়ন ও সম্প্রচারের দায়িত্ব বহুগুণে বেড়ে যায়। পর্যায়ক্রমে বহির্বিশ্ব ট্রান্সক্রিপশন কৃষি বাণিজ্য মনিটরিং সঙ্গীত শিক্ষা লিয়াজোঁ ও শ্রোতা গবেষণা বেতার প্রকাশনা জনসংখ্যা স্বাস্থ্য ও পুষ্টি এবং ট্রাফিক সম্প্রচার ইউনিট গঠনের মাধ্যমে সম্প্রচার কর্মকান্ড বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৩ সালের জুলাই ঢাকা কেন্দ্র আগারগাঁওয়ে আধুনিক স্টুডিও সম্বলিত জাতীয় বেতার ভবনে স্থানান্তরিত হয়। এখানে বেতারের প্রকৌশল শাখাসমূহ কেন্দ্রীয় বার্তা সংস্থা মনিটরিং পরিদপ্তর কৃষি ইউনিট এবং জনসংখ্যা স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেল অবস্থিত। ঠাকুরগাঁও কক্সবাজার বরিশাল রাঙ্গামাটি বান্দরবান ও কুমিল্লায় ১০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার সম্বলিত বেতার কেন্দ্র চালুর ফলে মোট স্টেশনের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২। সোভিয়েত সরকারের সহযোগিতায় ১০০০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার স্থাপন করে ধামরাইতে মহাশক্তি প্রেরণ কেন্দ্র চালু হয়। এতে বেতারের প্রচার সীমা অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। রাজশাহী খুলনা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সুস্পষ্ট করতে বগুড়া, নওয়াপাড়া ও কালুরঘাটে ১০০ কিলোওয়াট উচ্চশক্তি প্রেরণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। বহির্বিশ্বের শ্রোতাদের জন্য কবিরপুরে দুটি ২৫০ কিলোওয়াট শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার স্থাপন করে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, আরবি ও নেপালি ভাষায় দৈনিক সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ বেতারে অনুষ্ঠান প্রণয়ন ও সম্প্রচারের জন্য ৭১টি স্টুডিও এবং ১৫টি মিডিয়াম ওয়েভ, ৩টি শর্ট ওয়েভ ও ১২টি এফএম ট্রান্সমিটার রয়েছে। ভবিষ্যতে আরো ১২টি এফএম ট্রান্সমিটার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ বেতারের সকল কেন্দ্র ও ইউনিট দৈনিক মোট ২৫২ ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। এর মধ্যে সংগীতানুষ্ঠানই প্রায় ৬৫ শতাংশ। বাংলাদেশ বেতার বছরে প্রায় ৬০০ অর্থাৎ সপ্তাহে গড়ে ১২টি নাটক প্রযোজনা ও প্রচার করে থাকে। ১৯৬৭ সালে ঢাকার এক ঘণ্টার বাণিজ্যিক কার্যক্রম বর্তমানে বেতারের সকল কেন্দ্রের মাধ্যমে দৈনিক মোট ১৭ ঘণ্টার কার্যক্রমে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া প্রতি সপ্তাহে বেতারের কৃষি কার্যক্রম ৪ ঘণ্টা ৩০ মিনিট, ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস ২ ঘণ্টা, জনসংখ্যা, সতাস্থ্য ও পুষ্টি কার্যক্রম ৮ ঘণ্টা, ট্রাফিক সম্প্রচার ৮ ঘণ্টা, শিশু ও নারী উন্নয়ন কার্যক্রম ৬ ঘণ্টা ও শিক্ষা কার্যক্রম ১২ ঘণ্টা চলে। প্রতিদিন বেতারে ৬৭টি সংবাদ বুলেটিন, ২টি সংবাদ পর্যালোচনা এবং একটি নিউজ রিল প্রচারিত হয়। মনিটরিং পরিদপ্তর বিদেশের ২৫টি বেতারের সংবাদ ও চলতি ঘটনার অনুষ্ঠান মনিটর করে প্রতিদিন একটি রিপোর্ট সকল দপ্তরে প্রেরণ করে।

বেতারের ৭০ শতাংশ অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং, ডাবিং ও সংরক্ষণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা হয়। এই হার ২০১২ সাল নাগাদ ১০০%-এ উন্নীত হবে। বেতারের অধিকাংশ ট্রান্সমিটার ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্প্রচারের উপযোগী। দেশে ডিজিটাল বেতার গ্রাহক যন্ত্রের প্রচলন শুরু হলে বাংলাদেশ বেতার ডিজিটাল সম্প্রচারে যেতে পারবে। বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে বেতারের ওয়েব সাইট এবং মোবাইল এপস এর মাধ্যমে প্রতিদিন সব কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সরাসরি শোনা যায়।

বাংলাদেশ বেতার এশিয়া-প্যাসিফিক ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন, এশিয়া-প্যাসিফিক ইনস্টিটিউট ফর ব্রডকাস্টিং ডেভেলপমেন্ট ও কমনওয়েলথ ব্রডকাস্টিং এসোসিয়েশন এর পূর্ণ সদস্য এবং ব্রডকাস্টিং অরগানাইজেশন অব দ্য নন-এলাইন্ড কান্ট্রিজ ও ইসলামিক স্টেটস ব্রডকাস্টিং অরগানাইজেশন এর সহযোগী সদস্য। বাংলাদেশ বেতার ১৯৮২ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মোট ২৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ বেতার স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করে।

বাংলাদেশ বেতারে ছয়শো ছেষট্টিটি প্রথম শ্রেণীর পদসহ দুই হাজার সাতশত পঞ্চাশটি পদ রয়েছে। বেতারে বর্তমানে এগার হাজার স্টাফ আর্টিস্ট ও তালিকাভুক্ত শিল্পী রয়েছে।

সব তথ্য বাংলাপিডিয়া ওয়েব সাইট থেকে সংগৃহিত।
বাংলাদেশ বেতার এর লোগো : উইকিপিডিয়া

 

ফেসবুক মন্তব্য

About the author

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।