ষ্টকহোম ডায়েরী (১৫)

আমি যতটুকু দেখেছি আমার কাছে মনে হয়েছে সুইডেন পাহাড়ী এলাকা। তবে বিশাল বিশাল পাহাড় না, টিলা টাইপ, উচু নিচু এলাকা। বাংলাদেশের মতো আবার মাটির পাহাড় না, সব পাথরের। আর আছে বন, ডাউনটাউন থেকে বের হলেই দেখা যায় লম্বা-খাড়া সব গাছ উঠে গেছে আকাশের দিকে। ডাউনটাউন এ যা একটু বিল্ডিং দেখা যায়, এর বাইরে সবই সবুজ। ৬ তলার চাইতে উচু বিল্ডিং নেই বললেই চলে। ছোট একটা হিসাব দেই। আয়তনে সুইডেন বাংলাদেশের প্রায় ৩গুণ। এই এতো বড় একটা দেশে লোক সংখ্যা মাত্র ১০ মিলিয়ন (২০১৭) মানে এক কোটি।

এলতা মূলত আবাসিক এলাকা। স্কুল আছে, শপিং মল আছে ছোট একটা, খেলার মাঠ আছে যেখানে নিয়মিত ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলা হয়। শপিং মলে একটা বড় গ্রোসারি ষ্টোর আছে, পোষ্ট অফিস, নাপিতের দোকান আর উপরে পাবলিক লাইব্রেরী। এর বাইরেও গ্রোসারি ষ্টোর ছিলো আর ছিলো ছোট একটা ষ্টোর যেখানে ভিউ কার্ড থেকে শুরু করে বাসের মান্থলি টিকেট পাওয়া যায়। আমি যেখানে থাকতাম সেখানে সব ডুপ্লেক্স বাড়ী। কোন বাসার সামনে আবার কোন বাসার পিছনে বেশ কিছু জায়গা আছে। প্রতিটি বাসার সাথেই গ্যারেজ, এক বা একাধিক গাড়ী রাখা যায়। এলতা পোষ্ট অফিস যে অংশে সেখানে আবার সারি সারি এপার্টমেন্ট। এপার্টমেন্ট এবং শপিং মলের সাথে আছে কার পার্কিং। এর বাইরে সবই বন, বনের মাঝে আবার একটা লেকও ছিলো। লম্বায় কতটুকু জানা নাই তবে পাশে আমাদের উত্তরা লেকের ২-৩ গুণ হবে।

উভে’র সাথে একদিন হাটতে বের হয়েছি। দূরে কোথাও না, এলতার আশে-পাশেই। আমরা হাটছিলাম লেকের পাশ দিয়েই। লেকের পাশে দেখা যাচ্ছিলো ছোট ছোট ঘরের মতো, এগুলো নাকি ঘুরতে আসা লোকজন বিশ্রাম নেয়া কিংবা ঠান্ডা বাতাস থেকে সাময়িক বাঁচার জন্য ব্যবহার করে। ঘর গুলো বড় কিছু না, অনেকটা টং ঘরের মতো। একটাই রুম। কোন টয়লেট না দেখে উভে’কে বললাম সে কথা। উভে আমার কথা শুনে তো হেসেই খুন। বলে বনে-বাদারে টয়লেট পরিস্কার করবে কে ? এরপর যা বললো তার বাংলা করলে দাড়ায় প্রাকৃতিক কাজ প্রকৃতিতেই সেরে নেয়া ভাল। সামারে লেক দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিলো ধীর গতিতে। কয়েকমাস পর শীতের সময় আবার এসেছিলাম, তখন দেখা গেলো পানি জমে বরফ হয়ে আছে। এতোই পুরো বরফের স্তর যে তার উপর দিয়ে হাটা যায়। অভ্যাস না থাকলে অবশ্য আছাড়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। এই জমে যাওয়া লেকেও নাকি লোকজন মাছ শিকার করে। বরফে গোল করে একটা ছিদ্র করে বরশী নামিয়ে দেয়া হয়। এসময় মাছগুলো সাধারণত উপরের দিকেই থাকে জমে থাকা বাতাস থেকে অক্সিজেন নেয়ার জন্য। খূব সহজেই তারা ধরা পড়ে।

আমরা হাটছিলাম আর কথা বলছিলাম। হঠাৎ দেখি উভে নিচু হয়ে কি যেন একটু তুললো ছোট একটা ঝোঁপ থেকে। পকেট থেকে ছোট একটা পলিথিনের ব্যাগ বের করে সেটাতে রাখলো। আমার জিজ্ঞাসার জবাবে বললো এটা হলো বেরী। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে উভে এরকম আরো কিছু বেরী সংগ্রহ করলো, সাথে মাশরুম। বললো বেরীগুলো সালাদে যাবে আর মাশরুম স্যুপে। ওর দেখাদেখি আমি একটা মাশরুম তুলতে গেছি উভে সাথে সাথে জানালো এটা নেয়া যাবে না। ওর তোলা আগের একটা মাশরুম আর তুলতে যাওয়া মাশরুম দেখিয়ে বললো ভাল করে খেয়াল করো। মাশরুমের উপরের অংশের দিকটা দেখিয়ে বললো এইরকম একটা বা দুইটা ষ্টারের মতো দেখা গেলে সেগুলো খাওয়া যায়। তিন বা তিনের বেশী হলেই সেটি বিষাক্ত। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এসব জানলে কিভাবে। বললো স্কুলে থাকতে নিয়মিতই সামার ক্যাম্পে যেতো, সেখানেই এসব শিখেছে। 

এই এক মজার ব্যাপার সামারে। বাচ্চা থেকে শুরু করে বুড়োরাও ক্যাম্পিং করতে যায়। ছোট থাকতে স্কুল থেকে অথবা কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব সামার ক্যাম্পের আয়োজন করে। সামারে রাস্তায় বের হলে পিঠে ব্যাকপ্যাক আর রোল করা স্লিপিং ব্যাগ সহ অনেককেই দেখা যায়। হয় আসছে না হয় যাচ্ছে। আমার খূব মজা লাগতো ছোট ছোট বাচ্চাদের দেখে। পিঠে ছোট ব্যাকপ্যাক আর রোল করা স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে টুক টুক করে হেটে যাচ্ছে সারিবদ্ধ ভাবে। সাধারণত ৩ জন টিচার থাকে তাদের সাথে। প্রতিটি বাচ্চার কোমরে বেল্টের সাথে একটা আংটা থাকে, সেটার মধ্যে দিয়ে নায়লনের একটা দড়ি ঢুকিয়ে দেয়া হয়। দড়ির দু’মাথা থাকে ২ টিচারের কাছে। আর একজন থাকেন মাঝামাঝি জায়গায়। কোন বাচ্চা যাতে দলছুট হয়ে হারিয়ে না যায় তাই ব্যবস্থা। ক্যাম্পিং এর অপেক্ষাকৃত ভাড়ী জিনিসগুলি থাকে টিচারদের কাছে। উভের কাছে শুনেছিলাম ক্যাম্পিং এর সময় বেসিক সারভাইবাল ট্রেনিং দেয়া হয় মূলত। একা একা কিভাবে কি করতে হয় সবই শিখিয়ে দেয়া হয় এসব ক্যাম্পে। তাবু কিভাবে টানাতে হয়, আগুন কিভাবে জ্বালাতে হয়, মাছ ধরা, রান্না করা, পানি ফুটিয়ে বিশুদ্ধ করা এসবই থাকে ক্যাম্পিং এ। বড় হওয়ার সাথে সাথে বিষয়ও পরিবর্তন হয়। কখনও হয়তো থাকে সাঁতার শেখা, আর্ট / ড্রইং সহ আরো নানারকম বিষয়। সাথে বন-বাদারে ঘুরে এই সব বেরী, মাশরুম সহ গাছপালা, পাখি ইত্যাদি চেনানোর কাজ তো আছেই। 

বাসায় ফিরে এসে ভাবছিলাম আমাদের দেশেও আসলে এ রকম ক্যাম্পিং এর দরকার। ২৪ বছর বয়েসে প্রথম বিদেশে গিয়েছি, রান্না করা তো দূরে থাক অনেক কিছুই জানতাম না। প্রতি পদে পদে সমস্যা। স্বল্পকালীন প্রবাস জীবনে দিন তিনেক একা থাকতে হয়েছিলো, বাসার সবাই বাইরে গিয়েছিলো ঘুরতে। রান্না করাই ছিলো, আমাকে কেবল গরম করতে হবে এবং ভাত রান্না করতে হবে। প্রথমদিনের ভাত কেমন যেন গলা গলা হয়ে গেলো, দ্বিতীয় দিন গেলো পুড়ে। তৃতীয় দিন আরো কোন ঝামেলা না করে বার্গার আর রুটি কিনে এনেছিলাম। মেয়েরা মায়েদের সাথে থেকে এসব অনেক কিছুই শিখে। গ্রামের ছেলেরাও দেখেছি অনেক কিছুই পারে। সমস্যা কেবল আমার মতো শহরে বড় হওয়া ছেলেদের নিয়ে।  কিছুই শেখা হয় না। অথচ আমদের কেবল বই মূখস্ত করে পরীক্ষা দেয়ার পর সার্টিফিকেট একটা ধরিয়ে দেয়া হয়। চাকরি করতে গেলেও দেখা যায় পড়ার সাথে কাজকর্মের কোন মিল নাই। বাংলায় অনার্স-মাষ্টার্স করে ব্যাংকে কেরানীগীরি করে জীবন পার করেছেন এরকম উদাহরণ অনেক। 

সুইডেনের প্রাথমিক স্তরের পড়ালেখা এবং কাজকর্ম নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে কিছু লেখার ইচ্ছে রইলো। ভাল থাকবেন নিরন্তর।

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।