সুইডেনে লেখাপড়া শুরু হয় ৭ বছর বয়স থেকে। গোটা দূ’য়েক ডে কেয়ার সেন্টার চোখে পড়লেও কোন প্রি স্কুলের কথা কখনও শুনি নাই। স্কুল হলো টানা ১২ বছর। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়। তবে বেশীর ভাগ সুইডিশ এই ১২ বছরের শিক্ষার পর পড়ালেখা করে না। কোন না কোন কাজে ঢুকে যায়। যারা পড়াশোনায় অনেক বেশী ভাল তারাই যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। অথচ তাদের স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষাই অবৈতনিক।
উভে’কে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম সে আর পড়ালেখা করে নাই কেন এতো সূযোগ সূবিধা থাকতে। হাসতে হাসতে জবাব যা করেছে সেটাই যথেষ্ঠ। পরে অবশ্য সিরিয়াসলি বললো স্কুল থেকে বের হওয়ার পর নিজেকে অনেক বেশী স্বাধীন লাগছিলো। তারপর এই পোষ্টম্যানের চাকরিটাও তার বেশ পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো। উভে স্কুল থেকে বের হওয়ার পর সেই যে পোষ্ট অফিসে ঢুকেছে সেখানেই থিতু হয়ে গেছে।
সুইডিশ স্কুলে ইংরেজী শেখানো হয় ক্লাস থ্রি থেকে। এর আগে সবকিছুই মাতৃ ভাষায়। মজার বিষয় হলো এই ক্লাস থ্রি থেকে ইংরেজী শিখে তারা কিন্তু আমাদের চাইতে ভাল ইংরেজী বলতে পারে। অথচ আমরা প্লে গ্রুপ থেকে এইচএসসি পর্যন্ত নিয়মিত শিখেও ইংরেজীতে কথা বলতে পারি না। সুইডেনে যাওয়ার আগে আমার নিজেরও মনে হচ্ছিলো পেটে বোমা মারলেও মূখ দিয়ে ইংরেজী বের হবে না। সুইডিশ তরুনরা ইংরেজী ভালই বলে, যদিও ইংরেজী পারো কিনা জিজ্ঞেস করলে প্রায় সবাই বলে ‘লিটিল বিট’। একবার উভে’র ফুটবল ক্লাব পরিচালিত এক দোকান খূঁজতে গিয়ে মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। বাস ষ্টেশনে নেমে আমি আর সেই রাস্তা আর দোকান বের করতে পারিছিলাম না। আবাসিক এলাকা হওয়াতে তেমন কাউকে চোখেও পরছিলো না। শেষ মেষ দেখি ২ পিচ্চি ফুটপাত ধরে আসতেসে। শরমের কিছু নাই বলে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম তোমরা কি ইংরেজী বলতে পারো ? একজন তো দেখি মূখ লুকায়, আরেক পিচ্চি অবশ্য খূব স্মার্টলি বললো তুমি কিছু খূঁজতেসো ? রোডের নাম আর দোকানের নাম বলে ঠিকানা লেখা কাগজটা ধরিয়ে দিতেই পিচ্চি আমার হাত ধরে বললো আমার সাথে আসো। খূব বেশী দূরে ছিলো না অবশ্য। যেতে যেতে বেশ কিছু কথাবার্তা হলো। আমি কোন দেশ থেকে এসেছি, আমি কি খাই, আমার দেশের আবহাওয়া কেমন এই টাইপের শিশুতোষ প্রশ্ন। দোকানটা দেখার পর আমি ওকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম তুমি কিন্তু চমৎকার ইংরেজী বলো। পিচ্চি একগাল হেসে জবাব দিলো তার পাপা বিদেশে চাকরি করেছে কিছুদিন, সে সূত্রেই ইংরেজী শেখা। আরেকবার বাসে যাওয়ার সময় দেখি আমার পিছনের সিটে স্কুলের দুই মেয়ে বই দেখে ইংরেজী বানান শিখতেছে আর সুইডিশ অর্থ বলতেছে।
সুইডেনে আবার ২ বছরের সামরিক চাকরি বাধ্যতা মূলক। সবাইকেই একবার যেতে হয়। অসুস্থ হলে অবশ্য ভিন্ন কথা, ছেলে-মেয়ে কোন ভেদাভেদ নাই। (এই লাইনটা লিখে হঠাৎ একটু গুগল করলাম। উইকিপিডিয়া বলতেছে ২০১১-২০১৮ সাল পর্যন্ত এই নিয়ম রদ করা হয়েছিলো। ২০১৮ থেকে আবার শুরু হয়েছে। তবে এখন ১২ মাস এই সার্ভিস করতে হয়)
অথচ আমাদের বাংলাদেশের অবস্থা চিন্তা করেন। এসএসসি / এইচএসসি তে খারাপ রেজাল্ট করলেও তাকে জজ / ব্যারিষ্টার বানানোর কি নিদারুন প্রচেষ্টা। চাকরির বাজার ও তথৈবচ। যদিও বাংলাদেশে আমরা সবধরণের কাজ কে ভদ্রলোকের কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দেই না। অথচ এসএসসি বা এইচএসসি পাশের পর যে কোন কারিগরী শিক্ষা নিয়ে যে কেউ নিজের জীবন খূব চমৎকার ভাবে পরিচালনা করতে পারে। অনেক কাল আগে ট্রেনে এক ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। ছেলে কোন এক গ্যারেজে গাড়ীর মেকানিক। ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলো মনে হয়। এরপর বাবার মৃত্যুর পর সেই গ্যারেজে পেটে-ভাতে ঢুকেছিলো। শিখতে শিখতে হেড মেকানিকের পরের পোষ্টেই আছে এখন। আশির দশকেই মাসে তার আয় ছিলো ১৫ হাজার টাকার মতো। আরেক পরিচিত ছেলে বাবার মৃত্যুর পর খূব খারাপ অবস্থায় ছিলো। কোন রকমে ডিগ্রি পাশ করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে ঢুকেছিলো ২/৩ হাজার টাকার চাকরিতে। নিজ যোগ্যতায় আজ সে বেতন পায় লাখ টাকার কাছাকাছি। এরকম উদাহরণ অনেক। আসলে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে এই সব আলগা ফুটানির তোরে আমরা হয়তো গরীবই থেকে যাবো আরো কয়েক শতাব্দি।
শুভকামনা রইলো সবার জন্য।
ফেসবুক মন্তব্য