ষ্টকহোম ডায়েরী (১৪)

একদিন বাসে করে কাজে যাচ্ছি। রাশ আওয়ার এ বাস এবং সাবওয়েতে ভালই ভীড় হয়। আমাদের এখানকার মতো মানে বাংলাদেশের মতো গাদাগাদি করে না গেলেও রাশ আওয়ারে দাড়িয়ে যাওয়া যাত্রী অনেক। সবাই’কেই সময় মতো কাজে পৌছাতে হবে। একজনের পাশে আরেকজন এমনভাবে দাড়ায় যাতে অন্যের শরীরের সাথে না লাগে। সেদিন সিট পেলাম না। বাসের শেষের দিকে দাড়িয়ে আছি। সামনে এক জোড়া তরুণ-তরুণী। ওরা বোধহয় ক্যাম্পিং থেকে ফিরছিলো। সাথে ব্যাকপ্যাক আর অন্যান্য জিনিস দেখে বুঝেছিলাম। ছেলেটা বসেছিলো জানালার পাশে, মেয়েটা জাষ্ট আমার সামনে। দেখে মনে হচ্ছিলো ছেলে খূবই ক্লান্ত। সে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলো, কিন্তু বাঁধ সাধছিলো মেয়ে। যখনই সে মেয়ের কাধে মাথা রাখছিলো মেয়ে শুরু করছিলো চুমু দেয়া। যে সে চুমু না, কয়েক মিনিট ব্যাপি প্রগাঢ় চুম্বন যাকে বলে। আর আমি বাঙ্গাল না পারি বামে ডানে তাকাতে না পারি এই দৃশ্য হজম করতে। হলিউডি সিনেমার দৃশ্য যদি বাস্তবে চোখের সামনে দেখি তো কেমন লাগে। দুই কান দিয়ে মনে হয় গরম ভাপ বের হচ্ছিলো তখন। পরে দেখলাম এই দৃশ্য রাস্তা-ঘাটে প্রায়ই ঘটে।

আরেকদিন বাসে করে বাসায় ফিরছি। উইকএন্ডের রাত। বাস প্রায় খালি। বাসে উঠে মাঝামাঝি বসার পর বুঝলাম একদম পিছনের দিকে ৫/৬টা মেয়ে উঠেছে। তারা বেশ জোড়ে জোড়ে কথা বলছে, গান গাইছে। সাথে হাহা হিহি তো আছেই। বেশ কিছুক্ষণ পর বুঝলাম সবগুলো টাল, মানে কোথাও ড্রিংক করে আউট হয়ে গেছে। এই এক ব্যাপার উইকএন্ডে। সারা সপ্তাহ কাজ করে শুক্র-শনিবার রাতে হৈ চৈ করে বেড়ায় সব। শনিবার  বা রবিবার একটু ভোরের দিকে বের হলে দেখা যেতো এরকম অনেক লোক রাস্তায় যেখানে সেখানে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। আগের রাত্রে হয়তো এমনই ড্রিংক করেছে যে বাসায় যাওয়ার মতো আর অবস্থা ছিলো না। একবার বাসার সবাই মিলে এক মার্কেটে গিয়ে দেখি এক জায়গায় বেশ হৈ চৈ। পুলিশও চলে এসেছে। এক লোক পুরো মাতাল, অদৃশ্য কাউকে সমানে গালি-গালাজ করছে চলেছে। দুই পুলিশ নিরাপদ দূরত্বে দাড়িয়ে তাকে কিছু একটা বুঝানোর চেষ্টা করছে। আমি মনে মনে ভাবছি ব্যাটাকে চ্যাংদোলা করে ধরে নিয়ে গেলেই তো হয়। কাজিন’কে বললাম বাঁধে না কেন ? সে উত্তর দিলো এদেশে মাতাল মানে হলো অবুঝ, তার উপর জোড় খাটানো যাবে না। তবে মাতাল যদি কাউকে আক্রমন করে বা কারো সম্পত্তিতে ভাঙ্গচুর করে তখন ভিন্ন ব্যবস্থা। তখন শক্তি প্রয়োগ করা যাবে। এর মধ্যে আরো কয়েকজন পুলিশ চলে এসেছে। আর ঠিক তখনই মাতাল ব্যাটার রাগ মাথায় উঠলো। এক লাথি দিয়ে এক দোকানের ভিউকার্ড ষ্ট্যান্ড উল্টে দিলো। আর ঠিক তখনই চোখের পলকে পুলিশ এসে তাকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গেলো। এ প্রসঙ্গে একটা কথা শুনেছিলাম। ওরা বলে এভরি ওয়ানস’ রাইট। তবে সেই অধিকার ততক্ষণ পর্যন্ত বৈধ যতক্ষন পর্যন্ত না সেটি অন্যের অধিকারের ব্যাঘাত ঘটায়।

সুইডিশ সরকার তার নাগরিকদের অনেক ধরণের সূযোগ সূবিধা দেয়। যেমন – জন্ম থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ভাতা, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা, প্রতিটি নাগরিকের জন্য ফ্রি চিকিৎসা সূবিধা, বেকার ভাতা, পেনশন ইত্যাদি। তারপর বাস, ট্রেন, সাবওয়েতে ব্যাপক সাবসিডি তো আছেই। আর এসব সূবিধার বিপরীতে নাগরিকদের দিতে হয় আয়কর। আমি সব মিলিয়ে পেতাম প্রায় ৯-৯.৫ হাজার ক্রোনা প্রতিমাসে। আয়কর কাটার পর হাতে পেতাম ৫.৫ হাজার ক্রোনা। কথা প্রসঙ্গে একদিন উভে’কে বললাম এই কথা। এতো টাকা কাটে কেন। উত্তরে উভে বললো তার আরো বেশী কাটে। সাথে ব্যাখ্যা করলো যার যতো বেশী আয় তার ততো বেশী হারে আয়কর দিতে হয়। এরকম করার একমাত্র কারণ হলো যাতে কোন নাগরিক খূব বেশী ধনী বা খূব বেশী গরীব হয়ে না যায়। উভে হাসতে হাসতে বলছিলো তুমি এদেশে খুন করে পার পেতে পারো, কিন্তু আয়কর ফাঁকি দিয়ে পার পাবে না। কাউকে খুন করার মানে হলো একটি পরিবারের সর্বনাশ করা আর আয়কর ফাঁকি দেয়ার অর্থ হলো জনগনের সর্বনাশ করা। উভে অবশ্য বলেছিলো যে আমি যেহেতু অল্প সময় থাকবো সুইডেনে, বছর শেষে হিসাব করে আমার আয়কর থেকে কিছু টাকা ফেরত পাবো। দেশে ফিরে আসার পরের বছর ঠিকই চাচাত ভাই এর কল্যানে প্রায় এক হাজার ডলার ফেরত পেয়েছিলাম।

মাঝে মধ্যে স্বপ্ন দেখি প্রিয় বাংলাদেশও হয়তো একদিন এমনই হবে।

 

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।