পাসপোর্ট

আমার প্রথম পাসপোর্ট করা হয় ১৯৮৯ সালে। হাতে লেখা পাসপোর্ট। আব্বার অফিসের একজন ষ্টাফ করে দিয়েছিলেন। আমার কোথাও যেতে হয় নাই। কেবল ছবি তুলে আর ফর্ম ফিলআপ করে দিয়েছিলাম। কত টাকা লেগেছিলো সেটাও জানা নাই। সেই পাসপোর্টে সুইডেন গিয়েছিলাম। ফেরত আসার পর চেকোস্লোভাকিয়ার ভিসাও নেয়া হয়েছিলো, কিন্তু যাওয়া হয় নাই। ফারুখ, রকিব আর বাবলি সে সময় চেকোস্লোভাকিয়া গিয়েছিলো। সেখান থেকে অষ্ট্রিয়া। ফারুখ অনেকদিন যাবত দেশেই, ব্যবসা করছে। রকিব অষ্ট্রিয়া থেকে ইউকে আর বাবলি এখনও অষ্ট্রিয়াতেই আছে। সেই পাসপোর্ট আর কখনই রিনিউ করা হয় নাই।

দ্বিতীয় পাসপোর্ট করি ২০১৬ সালে, এমআরপি পাসপোর্ট। এই পাসপোর্ট করার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিলো ডুয়াল কারেন্সী কার্ড নেয়া, দ্বিতীয়ত ভ্রমণ। কিন্তু নানা কারণে ভ্রমণ করা আর হয়ে উঠে। আম্মা তো আগে থেকেই অসুস্থ্য ছিলো, এসময় আব্বাও অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। অবস্থা এমন ছিলো যে আমি উত্তরার বাইরে ও যাওয়ার সূযোগ খূব একটা পাই নাই। এই পাসপোর্টে কেবল ১০০০ ডলারের একটা এন্ডের্সমেন্ট ছিলো। আমি মনে হয় খূব বেশী হলে ২০০ ডলার খরচ করেছিলাম ইবিএল একুয়া কার্ড দিয়ে। 

এই পাসপোর্ট করতে তেমন বড় কোন ঝামেলা হয় নাই। অনলাইনে আবেদন করে প্রিন্ট কপি আর আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে উত্তরা পাসপোর্ট অফিসে গিয়েছিলাম। কাগজপত্র চেক করার সময় প্রশ্ন করলো ঢাকার বাসা নিজের কিনা। বললাম দুলাভাই এর। তিনি বললেন বর্তমান ঠিকানা হিসেবে ঠিক আছে, কিন্তু এটা আপনার স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে দেখানো যাবে না। হয় নিজের বাড়ী অথবা বাবার বাড়ী। আবার নতুন করে দেশের বাড়ীর ঠিকানা দিয়ে আবেদনপত্র রেডি করে যেতে হলো। এবার আর কোন ঝামেলা নাই। ছবি তুলে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে চলে আসলাম। পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় ঢাকার পুলিশ বেশ ভাল ব্যবহার করলো। টুকটাক প্রশ্ন করে বিদায় নিলেন। কিন্তু দেশের বাড়ীর ঠিকানা ভেরিফিকেশনের সময় পুলিশ বার বার বলছিলো তার সাথে দেখা করতে। শেষে দেশের বাড়ীর এক চাচাত ভাই’কে দায়িত্ব দিলাম। সে মোটামুটি কথাবার্তা বলে সব ঠিক করলো। বাকিটা আর না বললাম। 

২০২১ সালে এই এমআরপি পাসপোর্ট এক্সপায়ার হওয়ার পর ই পাসপোর্ট করছি করবো করে আর করা হয় নাই। এর মধ্যে ২০২১ সালে আম্মা আর ২০২২ সালে আব্বা মারা গেলেন। ২০২৩ এ এসে মনে হলো ই-পাসপোর্ট করে ফেলি। ভারত, নেপাল, ভুটান তো ঘুরে দেখা যায়। সেই সাথে ব্যাংকক, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ঘুরে দেখা যেতে পারে। আবার নতুন করে আবেদন করে করলাম। এবার বেশ কিছু নিয়ম পরিবর্তন হয়েছে। আবেদন করার সময় জমা দেয়ার তারিখ আর সময় সেট করতে হয়। সেই নির্দিষ্ট দিনে ঘন্টা খানেক আগে গিয়ে হাজির হলাম উত্তরা পাসপোর্ট অফিসে। গিয়ে বুঝলাম ঘন্টাখানেক আগে আসা ঠিক হয় নাই। টাইম স্লট ধরে ধরে লাইন হয়। যেমন আমার সময় ছিলো ১১:১০, সে হিসেবে আমার টাইম স্লট ১১:০০ – ১২:০০, আমাকে ১১টা বাজার মিনিট দশেক আগে লাইনে দাড়াতে হবে। সংশ্লিষ্ট লোকজনই সাধারণত বলে দেয়। 

আমি ঘন্টাখানেক বসে থেকে তারপর লাইনে দাড়ালাম। এই লাইনে খূব বেশী সময় লাগে নাই। আধ ঘন্টার মধ্যেই কাজ হয়ে গেলো। কাজ বলতে আবেদনপত্রে চোখ বুলিয়ে তারিখ আর সময় চেক করে সেদিনের তারিখের একটা সিল দিয়ে পাঠালেন ৩ তলায়।

এই লাইনে মোটামুটি ভালই সময় লাগলো। এখানের কাজ হলো সার্ভারে আমার আবেদনের সাথে মিলিয়ে দেখে প্রিন্ট করা আবেদন ভিতরে পাঠানো। সেখানে কোন উর্ধতন কর্মকর্তা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে সিল সহ সাক্ষর করবেন। এই লাইনে সাধারণত কাগজপত্র সব ঠিক মতো দেয়া হয়েছে কিনা ভালমতো চেক করা হয়। কোন কাগজ বাদ গেলে সেটি নিয়ে আসতে বলা হয়। যেমন একজনকে তার অরিজিনাল আইডি কার্ড দেখাতে বললেন। তিনি নিয়ে এসেছিলেন দোকান থেকে প্রিন্ট করা কপি। আরেকজন বয়স্ক মহিলাকে বললেন তার অবসর সংক্রান্ত কাগজ দিতে।  আমার আবেদন ভিতরে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। নাম ডাকতে উঠে গিয়ে আবেদন পত্র হাতে নিয়ে দেখলাম সেখানে সংক্ষেপে কিছু একটা লেখা। ষ্টাফ বললেন পাশের কাউন্টারের লাইনে দাড়াতে। 

এই লাইনেও ভাল সময় লাগলো। এখানে এনআইডি কার্ড আর পুরাতন পাসপোর্ট স্ক্যান করা হয়। বেশ লম্বা লাইন, তারপর আবার অনেকে দেখলাম এর ওর পরিচয় দিয়ে ব্যাকডোর দিয়ে ভিতরে ঢুকে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। আবার ৩ জনের জায়গায় কখনও কখনও ২ জন বা ১ জনও কাজ করছেন। আমার এই লাইনের কাজ শেষ হতে দেখলাম প্রায় দুপুর ২টা বাজে। 

এবার ছবি, ফিঙ্গার প্রিন্ট এর লাইন। চিপা একটা জায়গায় দাড়াতে হলো। আনুমানিক ৪০/৫০ জনের লাইন। একজন ভিতর থরকর বের হওয়ার পর জানলাম ভিতরেও প্রায় একই সংখ্যক লোক আছে। ণ্টাফ মাত্র ৩ জন। তারাও আবার কেউ কেউ বের হয়ে যাচ্ছেন, আবার আসছেন। মাঝে মধ্যেই অতি চালাক কেউ কেউ লাইনে ঢোকার চেষ্টা করছেন। তখন সমস্বরে সবাই চিৎকার করে তাকে নিবৃত্ত করছেন। রুম থেকে কেউ একজন বের হলে দশজন মিলে ঢোকার চেষ্টা করেন। তখন আবার হাউকাউ। একবার এক ধাক্কাতে বেশ কয়েকজন ঢোকার পর দরজার মোটামুটি কাছে আসতে পারলাম। ভিতরে উকি দিয়ে দেখলাম অনেক লোক। 

শেষতক আরেক ধাক্কাতে রুমে ঢুকে দেখি বেহাল অবস্থা। ১৬-২০ জন চেয়ারে বসা, প্রায় সম সংখ্যক লোক ঠাসাঠিসি করে দাড়িয়ে। দরজা খোলারও উপায় নাই। একবার এক আনসার সদস্য এবং একজন মহিলা ষ্টাফ এসে ঢুকতে গিয়ে আটকে গেলেন। তারপর আবেদনকারীরাই জায়গা করে দিয়ে তাদের ঢুকতে দিলেন। চেয়ারে বসা লোকজন থেকে একজন ছবি তুলতে গেলে দাড়ানো একজন বসার সূযোগ পাচ্ছেন। এভাবেই কাজ চলছে। ভিতরে টেবিল গোটা পাঁচেক, কিন্তু কাজ করছিলেন ৩জন। তাদের মধ্যে আবার টাইম টু টাইম ২/১ উঠে বাইরে যাচ্ছিলেন। এরমধ্যেও আবার ২/৩ জন্য অমুক তমুকের রেফারেন্সে এসে আগে কাজ করিয়ে নিচ্ছিলেন। এই হৈচৈ এর মধ্যে একজন সিনিয়র আনসার সদস্য এসে হস্তক্ষেপ করলেন। তার কাছ থেকেই জানলাম এই পাসপোর্ট অফিসে লোকবল সংকট তীব্র। যা আছে তার মধ্যেও কেউ কেউ আবার ছুটিতে থাকেন। একজন ষ্টাফ যিনি ছবি তুলছিলেন তিনি বললেন প্রতিদিন কাজ শেষ করে যেতে তাদের সন্ধ্যা ৭টা ৮টা বাজে। 

শেষ পর্যন্ত আমার পালা এলো। প্রথমে ছবি তোলা হলো, তারপর ফিঙ্গারপ্রিন্ট এবং সবশেষে আইরিস / রেটিনা স্ক্যান করা হলো। এক টেবিলেই সব কিছু। খূব বেশী সময় লাগে নাই। সব কাজ শেষে আমাকে একটা স্লিপ প্রিন্ট করে দিলেন। সব তথ্য সহ সম্ভাব্য ডেলিভারীর তারিখ দেয়া। 

বাইরে বের হয়ে দেখি বিকাল ৪:৩০ বাজে। মানে এই লাইনে আমাকে ২:৩০ ঘন্টা দাড়াতে হয়েছিলো। 

সম্ভাব্য ডেট এর ২ দিন আগেই এসএমএস পেলাম। সকাল ১০টার দিকে গিয়ে লাইনে দাড়ালাম। লাইন বিল্ডিং এর বাইরে পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। কিন্তু লাইন খূব দ্রুত এগোচ্ছিলো। কাউন্টারে গিয়ে সেই স্লিপ দিতেই সার্ভারে এন্ট্রি দিয়ে একটা প্রিন্ট করা স্লিপ দিলেন। সেখানে সিরিয়াল দেয়া। দোতালায় গিয়ে দেখলাম ২ লাইনে সিরিয়ালি ১০ জন ১০ জন করে ডেলিভারী দিচ্ছে। ১০জন শেষ হলে মাইকে পরবর্তী সিরিয়াল বলে দিচ্ছেন। অবশেষে আমার সিরিয়াল এলো। ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাই করার পর পাসপোর্ট হাতে দিলেন।

আমার এনআইডি এবং পুরাতন পাসপোর্টের কোন তথ্য পরিবর্তন হয় নাই বলে নতুন করে পুলিশ ভেরিফিকেশন হয় নাই। এবার লাইনে দাড়ানোর ঝামেলা ছাড়া আর কোন ঝামেলা ছিলো না। তবে শেষের লাইন ছিলো অবর্ননীয়। বের হওার পর শলিরে আর কোন এনার্জি ছিলো না। 

আপাতত এই হলো পাসপোর্টের ইতিহাস। 

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।