সদ্য প্রয়াত প্রখ্যাত আলোকচিত্রী জনাব আনোয়ার হোসেনের সাথে আমার কোন আনুষ্ঠানিক পরিচয় হয়নি।। আমি তার নাম প্রথম জানতে পারি সূর্যদীঘল বাড়ী ছায়াছবির সূত্রে। তারও অনেক পরে দৃক গ্যালারীতে বিভিন্ন এক্সিবিশন দেখতে গেলে তাকেও দেখতাম। কিন্তু এতো বড় মাপের একজন মানুষের সাথে আলাপ করার মতো সাহস কখনই হয়নি।
২০১৩ সালে শখের ফটোগ্রাফি গ্রুপ যখন প্রথম এক্সিবিশন Colors of Life করলো দৃকে, সেবারই প্রথম আলাপ হলো। তানভির এসে জানালো আনোয়ার হোসেন সাহেব এসেছেন। আমি গিয়ে দেখলাম ভদ্রলোক সিড়িতে দাড়িয়ে কার সাথে যেন আলাপ করছিলেন। আমি তাকে এক্সজিবিশন দেখার আমন্ত্রন জানালাম। উনি সহাস্যে বললেন আসতেছি একটু পর।
কিছুক্ষণ পর আসলেন। আমি তার কাছে গিয়ে দাড়াতেই তিনি বললেন তিনি কেবলই ছবি দেখবেন একা একা। তাকে যেন অনুসরন করা না হয়। ছবি দেখা হলে সবার সাথেই কথা বলবেন। আমি ফিরে এসে সবাই’কে বললাল সেকথা, তার পিছন পিছন যেন কেউ না হাটে। তিনি আস্তে-ধীরে সব ছবিই দেখলেন। দেখে এসে বসলেন। তাকে এক্সবিশন উপলক্ষে মূদ্রিত ক্যাটালগ এক কপি হাতে ধরিয়ে দিতেই বললেন তাকে চা খাওয়াতে হবে। আমি আর আর নিদাল নিচে গিয়ে চা নিয়ে আসলাম। ততকষনে তার চারপাশে অনেকেই চলে এসেছে, কথা বলছে। আমার আগের ভুল ভেঙ্গে গেলো একদিনেই। অত্যন্ত বড় মাপের আলোকচিত্রী হলেও কথাবার্তায় একেবারেই মাটির মানুষ।
প্সেসময় আমি আবার শখ করে চুল বড় রেখেছিলাম। একেবারে কাঁধ পর্যন্ত। অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য ক্যাটালগ একটা বাড়িয়ে দিতেই বললেন কখনও দাড়ি রেখেছি নাকি। না বলতেই বললেন লম্বা চুলের সাথে দাড়িতে আমাকে ভাল মানাবে। কথা শুনে আমি হেসে ফেলেছিলাম। বললেন আসলেই ভাল লাগবে, রেখে দেখো। অটোগ্রাফ দেয়ার সময় খেয়াল করলাম তিনি কলম দিয়ে নানা কিছু আঁকছেন। বললেন আর্ট কলেজে পড়ার খূব ইচ্ছে ছিলো, ফ্যামিলির জন্য পারি নাই। তাই কেউ অটোগ্রাফ চাইলে মাঝে মধ্যেই এরকম আকি। আফসোস সেই কপিটা একজন’কে দেখতে দিয়েছিলাম। যাওয়ার সময় কোন ফাঁকে নিয়ে গেছে খেয়াল করি নাই।
ছবিটবি নিয়ে টুকটাক কথা বলছিলাম। একসময় তার হাত ধরে উঠিয়ে নিয়ে গেলাম আমার তোলা ছবিটার সামনে। বললাম ভাল-মন্দ কিছু বলেন। বললেন ভালই হয়েছে, তবে এভাবে তো সবাই তুলে। কিছুটা ভিন্নভাবে তুললে হয়তো আরো ভাল লাগতো। সেই ভিন্ন ভাবে কিভাবে জানতে চাইতেই বললেন ধরো প্ল্যাটফর্মে একজন দাঁড়িয়ে মোনাজাত ধরেছে, তার হাতের ফাঁক দিয়ে তোলা যেতো ছবিটা। প্রয়োজনে কাউকে বলে দাড় করানো যেতো। আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে বললেন্ ছবি যে কেবল যা ঘটছে সেটাই তুলতে হবে এমন না, নিজের মতো করে সাজিয়েও ছবি তোলা যায়। যেটাকে ষ্টেজড ফটোগ্রাফি বলে। এতে দোষের কিছু নেই। যতদূর মনে পরে রায়হান ভাই এর তোলা ছবিটা তার খূব পছন্দ হয়েছিলো।
তাঁর সাথে আমার আরো বার দূ’য়েক দেখা এবং কথা হয়েছে। দৃকেই আরেকবার দেখা হলো APPB আয়োজিত এক এক্সিবিশনে। অনুষ্ঠান শুরুর আগে বেশ কিছুক্ষণ তার সাথে আলাপ করলাম। সেবার হাতে ছিলো শাউমি’র একশন ক্যাম। সেটা দেখে বললেন প্যারিসে এখন হাতে হাতে গোপ্রো। বিভিন্ন মিউজিয়াম থেকে শুরু করে আইফেল টাওয়ার, পথে ঘাটে সব জায়গায় দেখা যায় অসংখ্য টুরিষ্ট এই ক্যামেরা দিয়েই ভিডিও করছে।
প্শেষবার দেখা হয়েছিলো আলিঁয়স ফ্রসেস এ তার নিজের তোলা ছবি নিয়ে করা এক এক্সিবিশনে। আমি গিয়েছিলাম দূপুরের ঠিক পরপরই। তিনি ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। প্রথমে বসে কথা বললাম অনেকক্ষণ। তারপরউঠে ছবি দেখলাম। তার একটা ফটোবুক রাখা ছিলো। সেটাও এক পাতা এক পাতা করে পূরোটা দেখলাম। তারপর এক্সিবিশনের কিছু ছবি আর ফটোবুকের কিছু ছবি নিয়ে কথা বললাম তার সাথে।
প্ফেসবুকের সূত্রে অবশ্য তিনি ঢাকায় আছেন না, প্যারিসে – সেটা সবসময়ই জানতে পারতাম। শেষ ষ্ট্যাটাস দেখেছিলাম তিনি মাতৃভূমিতে আসছেন। ক’দিন পরেই জানলাম তিনি আর নেই। ঘুমের মধ্যেই চলে গেছেন অজানার দেশে।
যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন !!!
ফেসবুক মন্তব্য