ছোটবেলায় আমি একেবারেই দুষ্ট ছিলাম না। একেবারে তেজপাতা টাইপ। তবে মাঝে মধ্যে কিছু মিচকা শয়তানি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছি। আমি একদম ছোটবেলা থেকেই একটু অনুসন্ধিৎসু। মানে এটা কিভাবে হয়, ওটা কিভাবে হয় জানার ব্যাপারে উদগ্রিব ছিলাম। তাই দেখা যেতো আমার খেলনা বেশীদিন টিকতো না। জিনিসপত্র খুলে দেখায় ছিলাম সিদ্ধহস্ত, তবে খোলার পর আর লাগাতে পারতাম না। ধরা খেতাম সেজন্য।
আব্বা ছিলেন পলিটেকনিক ইনষ্টি্টিউট এর ইলেক্ট্রিক্যালের ইনষ্ট্রাক্টর (ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার)। বাসায় এক পুরাতন সুটকেস ভর্তি নানা রকম যন্ত্রপাতি ছিলো। তার কোনটা ভাল ছিলো, কোনটা নষ্ট। ছোটবেলায় এগুলো দিয়ে আমরা দুইভাই খেলতাম। তবে কড়া নির্দেশ ছিলো ভুলেও যেন ইলেকট্রিক্যাল সকেটে হাত না্ দেই। কারণ তাতে শক খেয়ে মারা যেতে পারি।
ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে পড়ার সময় শুনলাম কে যেন ইলেক্ট্রিক শক খেয়েছে, কিন্তু মরে নাই। তো আমারও শুনে মনে হলো মরে যখন নাই তাহলে আমিও একটু শক খেয়ে দেখতে পারি। একটা ছোট তার নিয়ে মক খাওয়ার আয়োজন শুরু করলাম। ছুটির দিন দূপুরে সবাই খাওয়ার পর ঘুমায়। আমি সে সূযোগটাই নিলাম। ড্রইংরুমে গিয়ে তারের একমাথা সকেটের এক ফুটায় ডুকালাম। এবার আরেক মাথা দুই আঙ্গুলে ধরে কাঁপাকাঁপা হাতে সুইচ অন করলাম। কিছুই ঘটলো না। সুইচ অফ করে তার আবার অন্য ফুটায় দিলাম। আগের মতোই আরেক মাথা দুই আঙ্গুলে ধরে এবার বেশ সাহসের সাথেই সুইচ অন করলাম। পলকে ছিটকে পড়লাম, পড়ার সময় পাশের কাঠের চেয়ারের সাথে ধাক্কা লেগে বিকট শব্দ হলো। আমি উঠে দাড়াতে দাড়াতেই দেখি আম্মা হাজির। আমার কাছে উত্তর রেডি ছিলো। হঠাৎ করে বেকায়দায় চেয়ারের সাথে ধাক্ক লেগে শব্দ হয়েছে। ভাগ্য ভাল সোফার কাছে পড়ে থাকা তারটা আম্মার চোখে পড়ে নাই। তবে এরপর আর শক খাওয়ার সাধ জাগে নাই। যদিও আরো ২/৩ বার বেখেয়ালে দূর্ঘটনাবশত শক খেয়েছি।
এর পরের কাহিনী ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়। কোন এক আত্মীয়ের বাসায় লা্ইট বাল্বে ঝুলানো মানিপ্ল্যান্ট গাছ দেখে মাথা ঘুরে গেলো। সেই বাসার এক ব ভাইকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম কি করে নষ্ট লইট বাল্ব দিয়ে এই অসাধারণ জিনিসটা তৈরী করা যায়। বাসায় ফিরেই ২/৩ টা নষ্ট লইট বাল্ব জোগাড় করে ফেললাম। এরপর প্রতিদিন একটু একটু করে সেটা নিয়ে কাজ করা শুরু করলাম। এতোটাই সাবধানে যে পিছনের শক্ত গালার মতো জিনিসটা অপসারণ করতেই কয়েকদিন লেগে গেলো। যেদিন ধূর্ঘটনা ঘটলো সেদিন বাসায় আম্মা ছাড়া আর কে কে ছিলো মনে নাই। আব্বা ছিলো অফিসে। বোন বা ছোট ভাই বাসায় ছিলো কিনা মনে করতে পারছি না। যাই হোক। এবার ভিতরে কাচের যে লম্বা জিনিসটা থাকে সেটা ভাঙ্গতে হবে। যন্ত্রপাতি বলতে স্ক্রু ড্রাইভার। নিজের বুদ্ধিতেই সব করছি। কেউ বলে নাই যে বাল্বটা মোটা কোন কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে কাজ করতে হবে। আমি খালি হাতেই বাল্ব থরে আরেক হাতে স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে খোঁচাখুঁচি করছিলাম। কোনভাবেই ভিতরের কাঁচটা ভাঙ্গতে পারছিলাম না। শেষে মনে হয় একটু জোড়েই চাপ দিয়েছিলাম। আর সাথে সাথেই পুরো বাল্বটা ভেঙ্গে গেলো। ভাঙ্গলো তো ভাঙ্গলোই, সাথে আমার দুই হাতের আঙ্গুলও কাটলো। আমি প্রথমে বাথরুমে গিয়ে রক্ত ধূয়ে ফেলতে চাইলাম। রক্ত পড়া বন্ধ হয় না দেখে, কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে রক্ত বন্ধ করতে চাইলাম। তারপর গেলাম ভাঙ্গা কাঁচ সরাতে। ভাঙ্গা কাঁচ জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়ার পর আবার গেলাম বাথরুমে। তখনও দেখি রক্ত বের হচ্ছে। আবার পানি দিয়ে হাত ধূয়ে ছোট কোন কাপড় খূজতেছিলাম এদিক সেদিক। পানি দেয়াতে চরম জ্বলতেছিলো। হঠাৎ আম্মার চিৎকার – রঞ্জু তুই কই, কি হয়েছে ? আমি ভাল মানুষের মতো জবাব দিলাম কিছু হয় নাই তো। আম্মা আমার সামনে এসেই খপ করে ধরে ফেললো – ফোঁটা ফোঁটা রক্ত সারা বাসায় ? কি করছিস বল। বুঝলাম আর উপায় নাই। আমি টুকরা কাপড়ের খোজে যখন এদিক সেদিক ঘুরতেছি, হাত থেকে তখন ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছিলো, আমার চোখেই পড়ে নাই।
আসল কথা বলা যাবে না। বললাম ঘরের ভিতর একটা ফড়িং ঢুকেছিলো, জানলার কাঁচের কাছে ধরতে গিয়ে কাঁচের ভাঙ্গা অংশে আঙ্গুল ঢুকে গিয়েছিলো। আম্মা কি বুঝলো কে জানে। কোথা থেকে পুরাতন ধোয়া একটি সুতি কাপড় ছিড়ে ডেটল দিয়ে হাত পরিস্কার করে বেধে দিলো। যদিও ২ জায়গায় ঠিকমতো বাঁধা যাচ্ছিলো না। দুইটাই ছিলো আঙ্গুলের চিপায়।
এর মধ্যে কাকে দিয়ে যেন আব্বার কাছে খবর পাঠিয়েছিলো। আব্বাও চলে আসলেন। আব্বা সোজা নিয়ে গেলো ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে, আমাদের বাসার পাশেই। সেখানেও আরেক দফা জিজ্ঞাসাবাদ। কি ভাবে কাটলো। আমিও ভদ্রলোকের এক কথার মতো ফড়িং ধরার গল্পটাই বললাম। এখানে বলে রাখা ভাল, সেসময় ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউটে প্রচুর ফড়িং দেখা যেতো। আর বাসার সেই জানালায় এক কোনায় ছোট একটা ভাঙ্গা ছিলো, যেটায় আমার একটা আঙ্গুল ঢোকানো যেতো।
তবে আমার গল্প যে তারা বিশ্বাস করে নাই সেটা আব্বার সাথে ফিসফিস করে কথা বলায় টের পেলাম। যাই হোক। তারা আয়োডিন দিয়ে পুরো কাটা অংশ আবার পরিস্কার করলো। আমার কেবল চিৎকার করা বাকি ছিলো। ব্যান্ডেজ করার পর মনে হলো এযাত্রা বাঁচা গেলো। কিন্তু ডাক্তার বললেন টিটেনাসের ইঞ্জেকশন একটা দেয়া দরকার। আব্বাও দেখলাম ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন। কি আর করা। ইঞ্জেকশন দিয়ে বাসায় ফিরলাম।
বাসায় ফিরে বেধরক পিট্টি আশা করছিলাম। কিন্তু আমার রক্ত দেখেই কিনা জানি না, আব্বা-আম্মা কেউই তেমন উচ্চাবাচ্য করলো না। এরপর বহুবার নষ্ট লাইট বাল্ব হাতে পেয়েছি, এক আধবার মানিপ্ল্যান্ট গাছের পটও বানাতে ইচ্ছে করেছে। কিন্তু ঐ ইচ্ছে পর্যন্তই। প্রতিবারই এই দূর্ঘটনার কথা মনে করে ইচ্ছেটা উবে গেছে।
ভাল থাকবেন।
ফেসবুক মন্তব্য