ভয়

আমি খূব সাহসী না, আবার খূব ভীতুও না। অবশ্য সাহসী বা ভীতু প্রমাণের মতো বড় কোন ঘটনাও ঘটে নাই জীবনে। এক অর্থে আমি হয়তো সূবিধাবাদী। তবে আজকের লেখা সেরকম কিছু নিয়ে না। ছোটবেলার দুটো ঘটনা বলবো, যেখানে আমাকে মোটামুটি ভীতুই প্রমাণ করে। 

তখন পড়ি চতুর্থ শ্রেণীতে। প্রতি ঈদেই দেখা যেতো আম্মা ঈদের পরদিন অসুস্থ্য হয়ে পড়তেন। পেটে প্রচন্ড ব্যথা। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন আম্মার পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে। একামাত্র সমাধান অপারেশন করে পিত্তথলি অপসারণ। তখন অবশ্য পেট কেটে তারপর অপারেশন হতো। আমার এক খালু তখন ডাকা সিএমএইচে কর্মরত ডাক্তার। তিনিই ব্যবস্থা করলেন অপারেশনের। যথা সময়ে অপারেশন হয়ে গেলো। 

অপারেশনের পর ২য় বা ৩য় দিন দূপুরে খাওয়ার পর আব্বার সাথে আমরা ৩ ভাইবোন মিলে রওনা হলাম সিএমএইচ এর উদ্দেশ্যে। সেদিন প্রচন্ড গরম ছিলো, আমরা গিয়েছিলাম বেবীটেক্সীতে করে। পৌছানোর পর আম্মাকে দেখলাম, কথা বললাম। আম্মার পেটে বড়সড একটা ব্যান্ডেজ। আম্মা তখনও বেশ দূর্বল। 

হাসপাতালে কে যেন ড্রাই কেক এনেছিলো। সেগুলো খেতে দিলো আমাদের। আমি মনে হয় বেশ কয়েকটা খেয়েছিলাম। একদিকে প্রচন্ড গরম, তারপর দূপুরে খেয়েই চলে এসেছি। তারপর এই ড্রাই কেক। আমার কেন জানি খূব অস্বস্তি লাগছিলো। আব্বার কাছে গিয়ে বললাম আমার কেমন জানি লাগতেছে। এরপর আর কিছু মনে নাই ….

খূব বেশী ক্ষণ না, পরের স্মৃতি হলো কেউ আমাকে কোলে করে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। তারপর একটা বিছানায় শুইয়ে দেয়া হলো আর একজন সিস্টার বলতেছে ‘বাবু ভয় পেয়েছো ?’

কাহিনী এই পর্যন্তই। তারপর থেকে আম্মার এই অপারেশনের কথা উঠলেই আমার কথা বলা হয় যে পেটে ব্যান্ডেজ বাধা আম্মাকে দেখে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়েছিলাম। 

দ্বিতীয় কাহিনী সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময়। আমরা তখন থাকি ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট এর পাশেই মেডিকেল কলেজ। সেখানে কি উপলক্ষে যেন একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিলো। একদিন বিকালে কোয়ার্টারের আরো কয়েকজনের সাথে একসাথে গেলাম সেই প্রদর্শনী দেখতে। বিভিন্ন কিছু আছে, তার মধ্যে বড় একটা অংশ হলো মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশ। বড় বড় কাঁচের জারে সেগুলো ‘ঔষধ’ দিয়ে সংরক্ষণ করা। সেসময় অবশ্য জানতাম না সেই ঔষধের নাম ফরমালিন। ঘুরে ফিরে দেখতেছি। বন্ধুদের কয়েকজন আবার ক্ষণে ক্ষণে বি করে দেয়ার ভঙ্গি করতেছে। আমার তিনটে জিনিসের কথা এখনও বেশ মনে আছে। একটা ছিলো মানুষের একটা মাথা। গলা থেকে কাটা পুরো মাথাটাই একটা বড় জারে সংরক্ষণ করা। আরেকটা অপেক্ষাকৃত ছোট জারে সাদা কি একটা প্যাঁচানো জিনিস, কাগজে লেখা ফিতা কৃমি। একজন মেডিকেল ষ্টুডেন্ট বললেন এটা নাকি লম্বায় অনেক বড়। আরেকটা জারে ছোট একটা বাচ্চা, বাচ্চাটার নাকি জন্মই হয় নাই। 

ঘুরছি ফিরছি দেখছি। একজায়গায় জটলা দেখে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু ভীড়ের জন্য ঠিক সামনে যেতে পারছিলাম না। ফাঁকফোকর দিয়ে দেখলাম একটা লাশ শোয়ানো আছে। মেডিকেল ষ্টুডেন্টরা পেটের ভিতরের বিভিন্ন অয়শ দর্শকদের হাতে তুলে নিয়ে দেখাচ্ছে। লাশটার গায়ের রং বেশ কালো, চামড়া কেমন যেন রাবারের মতো চকচক করছিলো। সামনে থেকে তেখতে পারছিলাম না বলে চলে আসছিলাম। বের হওয়ার মুখে করিডোরে দেখি একটা কংকাল’কে জামা পড়িয়ে দাড় করে রাখা হয়েছে। উপরের একটা এপ্রন, মাথায় মানে খুলি একটা স্কার্ফ দিয়ে ঢাকা। মুখের সামনের অংশ দেখা যাচ্ছে। এক আপা বললের কথা বল। আমি প্রথমে এক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম – কি বলবো। আমি কিছু বলার আগেই কংকাল বাবাজী নাকি গলায় বললো ‘কি চাস?’  এবার ঘটনা বুঝলাম। মজা করার জন্য কংকালের ভিতরে একটা মাইক আর স্পিকার সেট করে দিয়েছে। কেউ কোন কথা বললে অন্য কোথাও থেকে কেউ একজন তার উত্তর দিচ্ছে। আমি খূব সম্ভবত জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘আপনি কিভাবে মারা গেছেন ?’

যাই হোক বাসায় এসে আম্মা আর বোনকে বলেছিলাম কি কি দেখেছি। আম্মা তো শুনেই বকা। ‘তুমি ঐসব দেখতে গেছো কেন ? তুমি আমাকে হাসপাতালে দেখে অজ্ঞান হয়েছিলে মনে নাই?” কি আর করা। 

রাত্রে স্বপ্নে দেখেছিলাম সেই কালো লাশ টেবিলের উপর সটান উঠে বসে বিকট একটা হাসি দিচ্ছে। পরদিন সকালে দেখা গেলো আমার ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। 

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।