কপালের দোষ যতোই অস্বীকার করার চেষ্টা করি না কেন, মাঝে মধ্যে কারো কারো অবস্থা দেখলে আসলেই অসহায় লাগে। মনে হয় বেচারার কপালটাই মন্দ। আজ আবার নতুন করে সেই উপলব্ধি হলো।
আমার একজন নানা ছিলেন, নানুর ছোট ভাই। তার নাম মনে হয় ছিলো হোসেন, নানু ডাকতেন হোসা বলে। আমাদের সবার কাছেই সেই সুত্রে তিনি হোসা নানা। ভদ্রলোক ছিলেন ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর সাধারণ একজন সৈনিক। আমরা যখন তাকে দেখেছি তখন তিনি ভগ্ন স্বাস্থ্যের এক বৃদ্ধ লোক। সহজ সরল, নানুর ভাষায় তালকানা। তার আয় বলতে সেসময় কিছু রেশন আর বাড়ীর কিছু লিচু গাছ থেকে বাৎসরিক কিছু আয়। রেশনের সাথে মাসোহারা পেতেন কিনা জানি না। তবে তার অভাব সবসময়ই ছিলো। বেশ কয়েক মাস পর পর ঢাকা আসতেন। নানু এবং তার ছেলে-মেয়ে ভাতিজারা যে যা পারতো সাহায্য করতো। তার পরিবারটি আবার খূব ছোট ছিলো না। ৩ ছেলে, ৩ মেয়ে আর নানা-নানী। পৈত্রিক সূত্রে ময়মনসিংহ শহরের এক কোনায় ছোট এক টুকরা জমি পেয়েছিলেন। সেখানেই বিশাল এক রুমের বাড়ী ছিলো। আশেপাশে আরো ২/১টা ছাপড়া ঘর তুলে নিয়েছিলেন। একটা ছোট পুকুর ছিল, তার চারিদিকে ফলের গাছ। তবে লিচু গাছের সংখ্যাই বেশী। ছোটবেলায় প্রতি গ্রীষ্মে নানা সেই গাছের লিচু নিয়ে আসতেন ঢাকায়, বিলাতেন আত্মীয়স্বজনদের মাঝে। নানু মাঝে মধ্যে বকা দিতেন, কষ্ট করে গাড়ী ভাড়া করে এসব ঢাকায় আনার দরকার কি ছিলো। বিক্রি করলেও তো টাকাটা কাজে লাগে। কে শুনে কার কথা।
নানা একসময় মারা গেলেন। পরিবারটি পরলো মহা দূর্বিপাকে। বড় ছেলে, যে কিনা আমার সমবয়েসি সে হঠাৎ করে অপ্রকৃতস্থ হয়ে গেলো। অনেকেই অবশ্য তার এই অবস্থাকে বাস্তবতা থেকে দূরে চলে যাওয়ার অপকৌশল বলতো। আগে তো সারাদিন কেবল ময়মনসিংহ শহরেই ঘুরে বেড়াতো, এরপর শুরু করলো চিল্লায় যাওয়া। আজ এখানে, কাল ওখানে। নানী একসময় আশা ছেড়ে দিলেন তার বড় ছেলের ব্যপারে। নিজে টুকটাক সেলাই এর কাজ জানতেন, মেয়েদের নিয়ে সেটাই করতে থাকলেন বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। আত্মীয়-স্বজন যতটুকু পারে সাহায্য করতো।
এক আত্মীয় উদ্যোগী হয়ে বড় মেয়ের বিয়ে দিলেন। বড়পক্ষের নাকি দাবী ছিলো ছেলেকে চাকরি দিতে হবে। বিয়ের পর দেখা গেলো সেই আত্মীয় আর সেই ছেলের চাকরি দিতে পারছে না। ছেলে আর মেয়েকে বাড়ীতেও নিচ্ছে না। মাঝে মধ্যে অবশ্য স্বশুর বাড়ীতে ঘুরে যায়। এভাবেই একদিন তাদের ঘরে এলো এক ফুটফুটে মেয়ে। মেয়ের বাবা তখন টিউশনি করে বেড়ায় আর চাকরি খূজে। নানীও আগের মতো আর কাজ করতে পারেন না চোখের সমস্যায়। তাদের মেঝ ছেলেকে তাদের এক আত্মীয় নিজের কাছে নিয়ে গেলেন। মেঝ মেয়েকে আরেক আত্মীয় নিয়ে গেলেন, সেখানে এক রোগীর দেখাশোনা করতে হবে। আমি ১৯৯৫/৬ সালের দিকে ময়মনসিংহে গিয়ে শুনলাম সেই মেঝ ছেলে তার মামার বাসায় থেকে ছোট একটা ব্যবসা করে। কি ব্যবসা ? চরপাড়া বাজারে তরিতরকারি বিক্রি করে। মামার বাসায় থাকা খাওয়া ফ্রি। ব্যবসায়ে মূলধন ২০০ টাকা। নানী নাকি এই টাকা তাকে দিয়েছিলো বাসা ছেড়ে আসার সময়। সে প্রতিদিন ১৫০ টাকার তরিতরকারী কিনে, বাজারের এক কোনায় বসে বিক্রি করে। সারাদিনে হয়তো সবখরচ বাদ দিয়ে গোটা ত্রিশেক টাকা লাভ থাকে। কোন কোনদিন কিছু তরকারী বিক্রি হয় না, সেগুলো মামার বাসায় বা নিজেদের বাসায় দিয়ে আসে। ছোট ছেলে নানা কিছু করার চেষ্টা করে এখন মোটামুটি কিছু একটা করছে (কি করছে সেটা অবশ্য আমাকে বলে নাই)। শেষ খবর হলো মেঝ ভাই এখন নিজের বাড়ীতেই ফিরে এসেছে। এই দুই ভাই বিয়ে করে সংসারী।
মেঝবোন এবং ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে অনেক দেরীতে। আজ শুনলাম ছোট বোনের স্বশুর এবং স্বামী দু’জনেই করোনাক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সম্প্রতি। কারো কারো দুঃসময় মনে হয় কখনই শেষ হয় না।
এতো কিছুর মধ্যেও তারা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রবাসী কিছু আত্মীয়স্বজন এখনও তাদের সাহায্য করে যাচ্ছেন। খারাপ খবরের মধ্যে ভাল খবর হলো বড় মেয়ের জামাই নিজের চেষ্টাতেই ছোটখাট একটি চাকরি জোগাড় করে টিকে আছে। তাদের একমাত্র মেয়ে মাষ্টার্স শেষ করেছে, যেখানে তার মামা-খালারা হয়তো স্কুলের গন্ডিই পার হতে পারে নাই।
ভাল থাকুন।
ফেসবুক মন্তব্য