মরিস এর আদি দেশ হাঙ্গেরী। তরুণ মরিস ছিলো হাঙ্গেেরিয়ান এয়ার ফোর্সের ফাইটার প্লেনের পাইলট। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী শীতল যুদ্ধের সময় স্বপক্ষ ত্যাগ করে চলে আসে সুইডেন। রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের পর বানিজ্যিক বিমান চালানো শুরু করে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান এয়ারলাইনস এ। সুইডিশ এক মহিলাকে বিয়েও করে। স্ত্রী আর একমাত্র মেয়ে নিয়ে ভালই চলছিলো মরিসের জীবন। আজ এই দেশ, তো কাল ঐ দেশ। মেয়েও একসময় বেছে নেয় বিমানের কেবিন ক্রু এর পেশা। আর ঠিক এসময়ই ছন্দপতন হলো তার জীবনে। প্রচন্ড হার্ট এট্যাকে জীবন থেমে যাওয়ার উপক্রম হলো। সে যাত্রা জানে বেঁচে গেলেও বিমান সংস্থার মেডিকেল বোর্ড বিমান চালনার জন্য অনুপযুক্ত ঘোষণা করলো তাকে। কি আর করা। পেশাগত জীবন ছেড়ে অবসর জীবনে চলে যেতে বাধ্য হলো মরিস। বাড়ি ছিলো, ব্যাংক ব্যালান্স ও ছিলো ভাল, কিন্তু অবসর জীবন একসময় দূর্বিসহ হয়ে উঠলো তার কাছে। আর ঠিক তখনই সুইডেনের বাংলাদেশ দূতাবাস একজন শোফার (গাড়ীচালক / ড্রাইভার) চেয়ে বিজ্ঞাপন দিলো। মরিস গেলো ইন্টারভিউ দিতে এবং তার চাকরি যথারীতি হয়ে গেলো।
পরিচয়ের বেশ কিছুদিন পরে মরিস’কে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম বৈমানিকের জীবন ছেড়ে এই শোফারের জীবন কেমন লাগছে। সে সরাসরি উত্তর দিলো আমি আমার সময়টা ভালমতোই উপভোগ করছি। আমি তো টাকার জন্য চাকরি নেই নাই। টাকা আমার ভালই আছে। আমি চাকরি করছি কেবল সময় কাটানোর জন্য। আর বিদেশী দূতের গাড়ী চালানো আমার কাছে সম্মানজনকই মনে হয়।
ষ্টকহোম বাসের ৩য় দিন মরিসের সাথে পরিচয় হলো। সে ছিলো ছুটিতে। তাই এ কয়দিন তাকে দেখি নাই। টুকটাক আলাপের পর তার সাথে বের হলাম। সাব এর কারখানা সোদাতালিয়ায়, আমরা সেখানেই যাচ্ছি। মরিসের এক বন্ধু সেখানকার কর্মকর্তা। তার মাধ্যমেই এই চাকরি। লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে একসময় আমরা পৌছালাম কারখানায়। মরিস সিকিউরিটির অফিস থেকে কারো সাথে ফোনে কথা বললো। কারখানার ভিতর থেকে এক ভদ্রলোক বের হয়ে আসলেন আমাকে রিসিভ করার জন্য। মরিস আমাকে তার কাছে সপে দিয়ে চলে গেলো। আমাকে পথ চিনে বাসায় ফিরতে হবে।
যিনি এসেছিলেন তার নাম রনি ডাহলিন, পেশায় প্রকৌশলী। অথচ ড্রেসআপ দেখে বোঝার কোন উপায় নেই। কারখানার পোষাক পরনে। কারখানা এলাকা বিশাল বড়, আমরা ঢুকলাম এক বিল্ডিং এর ভিতর। উচু দোচালা টিপিক্যাল কারখানা বিল্ডিং। ভিতরে ঢুকে তো খাবি খাওয়ার অবস্থা। এতো বিশাল ছিলো বিল্ডিং। ভিতরে ঢোকার পর রনি কাউকে ডাক দিলো। ছোটখাট এক ছেলে এসে হাজির। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো, আকবর। রনি বললো আমাকে আপাতত আকবর কাজ শেখাবে কয়েকদিন। রনির নিয়ন্ত্রনে গাড়ী সংযোজনের যে অংশটুকু তার বিভিন্ন অংশে কাজ করতে হবে। তবে সবকিছুর আগে সকালের নাশতা। রনি আমাদের নিয়ে গেলো ক্যাফেটারিয়ায়। শুরু’তেই বলে দিলো সে আজ আমাদের দূ’জনকে খাওয়াবে। তার কথা শুনে আমি খূব অবাক হয়েছিলাম প্রথমে। খাওয়াবে ভাল কথা, এটা আবার এভাবে বলে কেউ। পরে অবশ্য জেনেছিলাম এদেশে (এবং উন্নত বিশ্বে) এটাই নিয়ম। কোথাও একসাথে খেতে গেলে যে যার মতো অর্ডার দেয়, বিল ও দেয় যে যারটা। তবে কেউ খাওয়াতে চাইলে সেটা আগেই বলে দেয়। খেতে গিয়ে আরেক বিপদ। রনি জিজ্ঞাসা করেছিলো আমি কি খেতে চাই। কোন খাবারই চিনি না। পরে রনিই সমাধান দিলো, পরিজ খাবো আমরা, পরে কফি। পরিজ যে কি জিনিস সেটা আর জানা হয় নাই, ঐ একদিনই খেয়েছিলাম। পাতলা ফিরনীর মতো। আমি খেয়ে খূব একটা মজা পাই নাই। কফি খেয়ে তো অক্কা পাওয়ার অবস্থা, এতো তিতা। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক কথা বললাম। তখনই জেনেছিলাম আকবর ইরানি। আমি হেসে বলেছিলাম ভারতীয় উপমহাদেশে এক মুঘল সম্রাট ছিলো আকবর নামে। আকবরও হেসে জানালো সে জানে এবং সম্রাটের নামেই তার নামকরণ হয়েছিলো।
নাশতার পর আবার এলাম কারখানায় এবার আকবরের প্রথম কাজ আমাকে পূরো শেড ঘুরে দেখানো। কোথায় কি আছে। কোথায় কি কাজ হয়। এরপর আজ টুকটাক কিছু কাজ করে বাসায় চলে যাবো। পরদিন থেকে পূর্নোদ্যমে কাজ শুরু।
সাব এর এই কারখানায় তৈরী হয় ট্রাক, মূলত আর্মি ট্রাক। পরে কাজ করার সময় দেখেছি কিছু কিছু ট্রাক তৈরী হচ্ছিলো ভারত এবং শ্রীলঙ্কার জন্য। বিভিন্ন শেডে বিভিন্ন জিনিস তৈরী হয়, কোনটায় ট্রাকের চেসিস, কোথাও ইঞ্জিন, কোথায় কেবিন, কোথাও অন্য কিছু। সবশেষে সব কিছু আসে এই শেডে সংযোজনের জন্য। শুরুতে চেচিসে চাকা লাগানোর পর ইঞ্জিন বসানো হয়, এরপর কেবিন। এই সময় বড় বড় পুলি আর হুক দিয়ে গাড়ীটাকে টেনে আনা হয় এসেম্বলি লাইনে। এসেম্বলি লাইন মানে হলো ষ্টিলের পাত দিয়ে তৈরী বিশাল দু’টি চেইন (অনেকটা মিলিটারি ট্যাংকের চেইনের মতো) পাশাপাশি চক্রাকারে ঘুরছে খূব ধীরে। বিশাল দুটি মোটর আছে আছে মাটির নিচে। চেসিসে চাকা, ইঞ্জিন এবং কেবিল লাগানোর পর বসিয়ে দেয়া হয় চেইনের উপর, চাকাগুলি থাকে দুই সারি চেইনের উপর। চেইন ঘুরে গাড়ী আগায় আর এর মধ্যেই কর্মীরা নানা কিছু সংযোজন করে ট্রাকে। একবারে শেষ মাথায় পৌছে কেউ একজন ট্রাক চালিয়ে নিয়ে যায় একটা বদ্ধ ঘরের ভিতর। সেখান থেকে চলে যায় বাইরে। এরপর ট্রাক কেমন চলে সেসবের নানা পরীক্ষা চলে। তার জন্য আবার রেসিং ট্র্যাকের মতো একটা ট্র্যাক ছিলো আলাদা।
কারখানা দেখতে দেখতে আকবরের সাথে নানা কথা হলো। সে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ইংল্যান্ডে ছিলো গত কয়েকবছর। কাগজ পত্র না থাকেতে চলে আসতে হয়েছে। এখানেও তার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির কোন দাম নাই, তাই আপাতত শ্রমিক। সে থাকে তার বাবা-মা ভাই-বোনের সাথে।
এই এসেম্বলি লাইন থেকে ঘন্টায় ৭টি ট্রাক বের হয়, মানে দিনে ৫৬টি। লাইনের দু’টি অংশ একটু অন্যরকম। একটি অংশে ঘরের মতো একটি কাঠামো আছে। সামনে পিছনে অটোমেটিক দরজা। ঘরের আবার দুই অংশ। এক অংশে ট্রাক থাকে, আরেক অংশে একজন অপারেটর থাকে। এই ঘরে চেসিসের কিছু কিছু অংশ ঝাঁলাই করা হয়, ঝাঁলাই এর পর রং করা হয়। দু’টি কাজই করে রোবট আর্ম। রং এর কণাগুলি খূবই সুক্ষ, নিঃস্বাসের সাথে ঢুকলে নাকি একধরণের আস্তর পরে যায় ফুসফুসে। সে কারণে বদ্ধ ঘরে এই কাজ করে রোবট। যে এই রোবটিক আর্ম চালায় তাকেও নভোচারীদের স্পেস স্যুটের মতো একটা স্যুট পরতে হয়, মাথায় সেরকমই একটি হেলমেট জাতীয় মাস্ক থাকে।
আরেকটি অংশে চেইনের উপর পুলের মতো অংশ থাকে, সামান্য উচু। ট্রাক উঠা নামার জন্য সামনে পিছনে ঢালু। এই অংশে ট্রাকের নিচে কাজ করার জন্য ফ্লোরের মাঝের অংশটিতে একটি খাদ আছে। নামার জন্য সিড়ি আছে। এই অংশে ট্রাক আসলে দুইপাশে হুকওয়ালা বড় একটি রড ট্রাকের সামনের আংটায় লাগানো হয়, অন্য মাথা লাগানো হয় মাঝ বরাবর ট্র্যাকটরের সাথে। বিমানবাহী রণতরীতে যেমন প্লেন’কে হুকের সাথে আটকে প্রচন্ড জোরে টেনে আকাশে উড়িয়ে দেয়া হয়, এটা অনেকটা সেরকমই, তবে গতি অসম্ভব ধীর। ট্রাক যেহেতু চালানো হচ্ছে না, চেইনে বসানো বলে চলন্ত চেনের সাথে সামনে আগায়। কিন্তু এই পুলের মতো অংশটুকুতে চেইন থাকে পুলের নিচে। আর এই অংশ পার করার জন্য টেনে নিতে এই ব্যবস্থা। কারখানায় কাজ করার সময় আমি গোটা তিনেক ঘাপলা করেছিলাম। তার মধ্যে দুটি ছিলো এই অংশে। সেসব নিয়ে না হয় আরেকদিন বলবো।
কারখানা পরিদর্শন শেষে আবার গেলাম রনির কাছে। এবার রনি আমার জন্য ২ সেট ইউনিফর্ম, সাথে জুতার ব্যবস্থা করলো। লকার রুম, সাথে বাথরুম দেখিয়ে দিলো। ছেলে-মেয়েদের আলাদা লকার রুম আর বাথরুমের ব্যবস্থা। প্রতিদিন সকালে এসে আমার লকার থেকে ইউনিফর্ম নিয়ে বদলাতে হবে, পরে আসা জামা-কাপড় লকারে রেখে কাজে। আবার কাজ শেষে ইউনিফর্ম পরিবর্তন। কাজ শেষে ইচ্ছে করলে একেবারে গোসল সেরে বাসায় যেতে পারি। আকবর এসময় আস্তে করে কানে কানে বললো সবার সামনে দিগম্বর হয়ে গোসল করার অভ্যাস থাকলে ট্রাই করো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই মুচকি হেসে বললো কালই টের পাবে। সবশেষে দেখানো হলো লন্ড্রি। ইউনিফর্ম ময়লা হলে এখানে ধোলাই এর জন্য দিতে হবে।
সবশেষে আমার জন্য বরাদ্দ হলো একটা আইডি এবং পাঞ্চ কার্ড। মেইন গেট দিয়ে ঢোকার সময় আইডি দেখাতে হবে। আর ফ্যাক্টরি শেডে কাজে ঢোকার সময় প্রতিদিন মেশিনে এই কার্ড পাঞ্চ করতে হবে, আবার বের হওয়ার সময়। আমাকে বললো কার্ড পাঞ্চ করতে, করলাম। রনি পাশে কলম দিয়ে কি যেন লিখে দিলো। বললো আজ কাজ না করলেও হাজিরা হয়ে গেলো তোমার। এরপর কাজের সময়সূচি বুঝিয়ে দেয়া হলো। একদম টাইম মতো আসতে হবে। মাঝে বেশ কিছু বিরতি আছে, নাশতার এবং কফি ব্রেক। ইচ্ছে করলে আমি বাসা থেকে খাবার আনতে পারি। ফ্যাক্টরি শেডের ভিতরেই ছোট একটা ঘরের মতো আছে, খাবারের দোকান। টাকা দিয়ে এখান থেকেও খাবার কিনতে পারি। তবে কফির জন্য আলাদা কার্ড আছে, টাকা দিয়ে কিনতে হয়। ভেন্ডিং মেশিনে পাঞ্চ করলে কফি বের হয়।
আমি আরো কিছুক্ষণ থাকলাম। কাজ ধেখলাম। আকবরের সাথে টুকটাক হাত লাগালাম। মনে হচ্ছিলো সহজ কাজই তো। মূলত নাট বল্টু লাগানো। পরে কাজ করতে গিয়ে টের পেয়েছিলাম যত সহজ মনে হয়েছিলো, ততো সহজ ছিলো না। লাঞ্চ ব্রেকের সময় রনি বললো আজ ইচ্ছে করলে চলে যেতে পারি। তবে কাল সময় মতো আসতে হবে। আমি চিন্তা করে বললাম ট্রেন ষ্টেশন পর্যন্ত রাস্তা চিনতে হবে, নাহলে কাল আবার চিনে আসতে পারবো না। আজতো এসেছিলাম গাড়িতে। রনি আমার সাথে মেইন গেট পর্যন্ত আসলো। ষ্টেশন কোন দিকে বুঝিয়ে দিলো। আমি হাটা দিলাম ষ্টেশনের দিকে।
ফেসবুক মন্তব্য