রীতা দিদি

আমার প্রথম স্কুল ছিলো তেজগাঁও এর বটমলি হোম গার্লস হাই স্কুল। গার্লস স্কুল হলেও ছেলেরা ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়তে পারতো। একমাত্র বড়বোন স্বাধীনতার আগে এই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলো। আমরা তখন থাকতাম তেজগাঁও পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট এর ষ্টফ কোয়ার্টারে। পশ্চিম পাশে অনতি দুরে তেজগাঁও ষ্টেশন্ রেললাইন পার হলেই সারি সারি রেলওয়ে কোয়ার্টার। কংক্রিটের রাস্তা ধরে এগোলেই স্কুল। পাশেই ছিলো হলিক্রস স্কুল। 

১৯৭২ সালে সেই স্কুলেই ভর্তি হলাম ক্লাস টু’তে। তখন ক্লাস টিচার ছিলেন মিলন দিদি। এরপর ক্লাস থ্রি’তে পুস্প দিদি। ১৯৭৪ সালে ক্লাস ফোরে উঠে পেলাম রীতা দিদিকে। রীতা দিদি’র ব মেয়ে শিখা ক্লাস টু থেকেই আমাদের সাথে পড়তো। 

রীতা দিদি
রীতা দিদি

রীতা দিদি’র সাথে সেই সময়ের স্মৃতি খূব একটা স্পষ্ট না। কেবল মনে আছে হালকা-পাতলা ছোটখাট চশমা পরা একজন মহিলা। ক্লাসের স্মৃতি বলতে মনে আছে একবার দিদি ক্লাসে ৬ জন নাকি ৮ জন’কে ক্লাস মনিটর বানিয়েছিলেন। জোড়া জোড়া ছিলো। যেমন – সেই সময়ের অন্যতম ভাল ছাত্র বলে পরিচিত সাব্বির আর আইরিন একজোড়া। প্রত্যেকের আবার দুটো করে বেঞ্চ সামলানোর দায়িত্ব ছিলো। সাব্বিরের কাজ ছিলো নিজের দল সামলানো ছাড়াও আইরিনের দলের দিকে নজর রাখা। কেউ কথা বললে বা দুষ্টামি করলে দিদির কাছে রিপোর্ট করা। একই দায়িত্ব ছিলো আইরিনের। পড়াশোনায় এই দু’জন যেমন একজন আরেকজনের প্রতিদ্বন্দ্বী, ক্লাস মনিটর হিসেবেও দেখা গেলো একই কাহিনী। একবার আইরিন রিপোর্ট করে তো আরেকবার সাব্বির। সে তুলনায় বাকিদের রিপোর্ট করার হার খূবই কম। 

আমিও ক্লাস মনিটর হয়েছিলাম। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো হিয়া। আমার যতদুর মনে পড়ে কালেভদ্রে আমরা দিদির কাছে রিপোর্ট করতাম। এমনিতে হিয়া খূবই শান্ত মেয়ে ছিলো। খূব আস্তে-ধীরে কথা বলতো। ক্লাস ফাইভের পর আর ওর সাথে দেখা হয় নাই। তবে ১৯৯০/৯১ এর দিকে সাব্বির তার এক প্রতিবেশীর বাড়ী দেখিয়ে বলেছিলো এই বাড়ীর ছেলের সাথে হিয়ার বিয়ে হয়েছে।

আরেকটা ঘটনা মনে আছে। শেষ পিরিয়ড চলছে। আমার পাশে বসা ছিলো রাজু। রাজু কেবল সহপাঠিই ছিলো না, কোয়ার্টারে প্রতিবেশীও ছিলো। তো ক্লাসে দিদি বোর্ডে লিখে কি যেন বুঝাচ্ছিলেন। এক বিড়াল এসে সামনের দুই পা তুলে দিয়েছিলো লো বেঞ্চে, সাথে নখ দিয়ে রাজুর শার্ট টানছিলো। ঘাঁড় ঘুড়িয়ে দেখতে গিয়ে আমি আর রাজু দুজনেই হেসে ফেলেছি। আর যায় কোথায়। দিদি দেখে দু’জনকেই নিলডাউন। একদম ক্লাস শেষ হওয়া পর্যন্ত। ক্লাস শেষে দিদি জিজ্ঞাসা করেছিলেন হাসার কারণ। সব শুনে বললেন ক্লাসে অন্য কোন দিকে আর তাকাবা না। 

আইরিন, আমি, শিপ্রা, রীতা দিদি, মুনমুন
আইরিন, আমি, শিপ্রা, রীতা দিদি, মুনমুন

সেই রীতা দিদির সাথে দেখা হলো প্রায় ৫০ বছর পর। স্কুলের ৭৫তম বার্ষিকীতে এসেছিলেন। বয়স হয়ে গিয়েছে, নানা রোগে শরীরও ভাল নেই। বেঁচে আছেন এবং নিজের পায়ে এখনও চলাফেরা করছেন দেখে ভাল লাগলো। এখন থাকেন আমেরিকা। মাঝে মধ্যে কানাডায় যান শিখার কাছে। তবে তাঁর নাকি বিদেশে থাকতে ভাল লাগে না। ঢাকাতেও না। দেশে, গ্রামের বাড়ীতেই থাকতে ভাল লাগে। রীতা দিদির সাথে শিখার ছোট বোন শিপ্রার সাথেও দেখা হলো। অবসরের পর মিলন দিদি চলে গেছেন গ্রামে। পুস্প দিদি আর সিষ্টার মেরী রাণী বেঁচে নেই। ক্লাস ওয়ানের মার্টিনা দিদির খবর জানতে পারি নাই। 

সহপাঠি হিয়া্ কয়েক বছর আগে ক্যান্সারে ভুগে মারা গেছে। এ খবর পেয়েছিলাম হিয়ার বড়বোন আপন আপার কাছ থেকেই। এ যাত্রায় সহপাঠিদের মধ্যে দেখা হলো কেবল আইরিন আর মুনমুনের সাথে। শিখা আর পল্লব ফেসবুকে কানেক্টেড, ঞয়তো কোন একদিন দেখা হয়ে যাবে। সাব্বিরের সাথে কয়েক বছর পর পর হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়। ১৯৮১ সালে দেখা হয়েছিলো কলেজে, এরপর ১৯৯০ সালের দিকে দেখা হলো স্প্যানিশ ভাষা শিখতে গিয়ে। বেশ কয়েক বছর যোগাযোগ ছিলো। এরপর হঠাৎ করেই যোগাযোগ নাই।

প্রিয় দিদিরা এবং সহপাঠিরা ভাল থাকুক এই কামনাই করি।

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।