ষ্টকহোম ডায়েরী (১০)

১. একদিনের ঘটনা। দাড়িয়ে আছি বাসষ্ট্যান্ডে, বাসের অপেক্ষায়। আমার সামনে আরো কয়েক জন যাত্রী। হঠাৎ এক ঝলক দেখলাম। নজর কাড়লো অসাধারণ সোনালী চুল। সোনালীর মাঝে মধ্যে আবার কিছু গাঢ় রং। চুলের রং এর চেয়েও অসাধারণ তার কেশবিন্যাস। চুলগুলো প্রথমে বেনী করা হয়েছে। তারপর সেই বেনী দিয়ে প্যাঁচানো একটা খোঁপা। খোঁপায় গুজে দেয়া হয়েছে চমৎকার কারুকাজ করা একটা কাঁটা। খূব সম্ভবত হাতীর দাঁতের তৈরী। মাথায় অপেক্ষাকৃত ছোট একটি হ্যাট। তাতে আবার সাদা একটি পালক গোঁজা। আমি দেখছিলাম পিছন দিক থেকে। পরনে সাদা ট্রাউজার, সাদা স্যুট। পায়ে সাদা জুতা।

এটুকু দেখেই মনে মনে ব্যাকুল হয়ে আছি সামনে থেকে দেখার জন্য। না জানি কেমন বেসম্ভব সুন্দরী। আমি এক-আধবার একটু ডানে-বামে গিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। কোন লাভ হলো না।

শেষ পর্যন্ত বাস এলো। একজন একজন করে টিকেট কেটে অথবা মান্থলী টিকেট দেখিয়ে উঠছে। আমি যখন বাসের পাদানিতে পা রাখব, তখন প্রথম বারের মতো সুন্দরী কে পাশ থেকে দেখার সূযোগ পেলাম।

মনে হলো আমার সত্যি একটা হার্ট এটাক হয়ে গেলো। পাশ দিয়ে যেতে যেতে আরেক ঝলক দেখলাম। একি দেখলাম আমি। সিটে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ।

সে ছিলো বাদামী দাড়ি ওয়ালা সোনালী চুলের ব্যাটাছেলে একজন।

২. আরেক দিনের কাহিনী। সাবওয়েতে ট্রেনের অপেক্ষায়। ট্রেন আসতে কিছুটা দেরী আছে। হঠাৎ টক টক শব্দে সচকিত হলাম। এক আল্ট্রা মডার্ন তরুণী তার হাই হিলের শব্দ তুলে হাজির হলেন। পরনে মিনি স্কার্ট, গায়ে ছোট জ্যাকেট। দুটোই চামড়ার। জ্যাকেটে আবার মেটালের কিসব দিয়ে ডিজাইন করা। মুখে গ্লিটার টাইপের কিছু ছিটানো ছিলো, তার নড়াচড়ার সাথে চিক চিক করছিলো।

তবে দেখার মতো বিষয় ছিলো তার চুলের কালার। নীল-বেগুণির মিশেল দেয়া রং, মেটালের মতো চক চক করছিলো। আমি এই কালার দেখে কিছুটা মোহিত। বলা চলে ষ্টকহোম আসার পর থেকেই বিভিন্ন ধরণের চুলের কালার আর ষ্টাইল দেখে রীতিমতো বিমোহিত ছিলাম। তবে কোনটা যে জন্মগত আর কোনটা যে ডাই করা সেটি বুঝতাম না।

কথা বলার সময় ছাড়া এমনিতে কেউ কারো মূখের দিকে তাকিয়ে থাকে না। একধরণের অভদ্রতা। তবে কথা বলার সময় সোজাসুজি চোখে চোখ রেখে কথা বলাই নিয়ম, আমরা বাঙ্গালীরা যা আবার করি না। যাই হোক। আমি মনে হয় এতোটাই বিমোহিত হয়েছিলাম তরুণীর চুলের রং দেখে যে কয়বার তাকিয়ে ছিলাম সেটা নিজেরও খেয়াল নাই। কাছেই ছিলাম দাড়ানো, একসময় তরুণী কি যেন বললো আমার দিকে তাকিয়ে। বললাম সুইডিশ বুঝি না। উত্তরে ঝড়ঝড়ে ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করলো আমার কোন সাহায্য লাগবে কিনা। বুঝলাম কয়েকবার তাকানোতে মনে করেছে বিদেশী কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়। বললাম তোমার চুলের রং দেখে আমি আসলে বিমোহিত। আমার দেশে চুলের রং শুধূমাত্র কালো, বুড়ো হলে হয়তোবা সাদা। তোমাদের দেশে এসে বিভিন্ন কালারের চুল দেখে কিছুটা কনফিউজড। কোনটা আসল আর কোনটা রং করা বুঝি না। মেয়ে আমার কথা শুনে হেসেই ফেললো। হাসতে হাসতেই বললো তার চুল ডাই করা। এটার নাম ইলেক্ট্রিক ব্লু।

তার কাছ থেকে জানলাম সোনালী, বাদামী, লালচে, ছাই (আরো ২/৩টি কালারের নাম বলেছিলো) কালার এসব আসল জন্মগত, তবে এগুলো রং ও করা যায়। বাকি গুলো সব ডাই। জিজ্ঞেস করলাম তোমার এই রং থাকবে কয়দিন। বললো রং থাকে বেশ কিছুদিন, কিন্তু চকচকে ভাবটা সহজেই হারিয়ে যায়।

কথা বলতে বলতেই ট্রেন চলে আসলো। আমি ‘থাক সো মিক্কে’ (অনেক ধন্যবাদ) বললাম। সে বললো ‘হেইডো’ (বিদায়)। রওনা হলাম যে যার গন্তব্যে।

৩. সাব কারখানায় থাকাকালিন লাঞ্চের সময় গল্প হচ্ছে। একজন জানতে চাইলো বাংলাদেশের লোকেদের মূল খাদ্য কি। বললাম ভাত। পরবর্তী প্রশ্ন হলো সপ্তাহে কয়দিন খাও। প্রশ্ন শুনে একটু ভরকে গিয়েছিলাম। বললাম সপ্তাহে না, দিনে দুইবার আর গ্রামের দিকে বা অপেক্ষাকৃত গরীব যারা তারা দিনে তিনবারই খায়। আমার উত্তর শুনে প্রশ্নকর্তার চোখ দেখি গোল গোল হয়ে গেছে। পরে বললো সে মাঝে মধ্যে ভাত খায় অবশ্য, তার গার্লফ্রেন্ড ফ্লেভার্ড রাইস রান্না করে। ফ্লেভার্ড রাইস কি জিনিস বুঝতে গিয়ে বুঝলাম পোলাও টাইপের কিছু। একজন অবশ্য বললো সে কালে-ভদ্রে ভাত খায় স্বাদ বদলানোর জন্য, তবে সেটা নরমাল রাইস। যারা ভাত খায় তারা দেখলাম বাসমতি রাইস কিনে। ভাত খাওয়া সুইডিশরা অবশ্য ৩ বেলা ভাত খাওয়ার কথা শুনে বলছিলো তাতে তো ভুড়ি বেড়ে যাওয়ার কথা। আমি অবশ্য বলেছিলাম দুপুরে ভাত খেলে ঘুম পায় বেশী।

৪. একদিন এক সুপার মার্কেটে গেছি, উদ্দেশ্য DIY টাইপের কিছু খেলনা কেনা। সেন্ট্রাল ষ্টেশনের ইল্টা দিকে বড় একটি ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর। নাম মনে নেই। মাটির উপর ৪ তলা, মাটির নিচে ২ তলা। নিচের ২ তলায় অবশ্য সব পচনশীল খাদ্যদ্রব্য। খেলনা খুজছি, পাচ্ছিলাম না। শপ এসিট্যান্ট কে ডেকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম। সে আবার ফোনে কার সাথে যেন কথা বললো। লাভ হলো না কিছুই। শেষ পর্যন্ত এক কোনা থেকে একটা উদ্ধার করলাম যার বক্স আবার ছেড়া। তবে ঘটনা হলো টয় সেকশন থেকে আমি যতবার পরের সেকশনের কাছাকাছি যাচ্ছিলাম দুই পিচ্চি ছেলে আমাকে দেখে এক মিচকা হাসি দিয়ে সরে যাচ্ছিলো। প্রথম দিকে খূব একটা খেয়াল করি নাই। শেষবার খেলনার বক্স হাতে নিয়ে যখন পাশের সেকশনে গেলাম, তখনও দুই পিচ্চি রহস্যময় মিচকা হাসি দিয়ে চলে গেলো। এই সেকশনে বিভিন্ন ধরণের প্যাকেটজাত স্ন্যাকস, যার মধ্যে বিভিন্ন ধরণের চিপস ছিল। ভাবলাম দুই ভাতিজীর জন্য দুই প্যাকেট চিপস নিয়ে যাই। চিপস পছন্দ করতে গিয়ে দুই পিচ্চির রহস্যময় হাসির মর্মার্থ আবিস্কার করলাম। এক কোনায় একদম নিচের দিকের তাকে বড় একটা চিপস এর প্যাকেট, হঠাৎ করে চোখে পড়ে না। সেটা আধ খোলা হয়ে আছে, প্রায় অর্ধেক প্যাকেট খালি। বুঝলাম দুই বন্ধু মিলে এতোক্ষণ এই জিনিসের সদ্ব্যবহার করছিলো। আকর্ণ বিস্তৃত হাসি নিয়ে আমি কাউন্টারের দিকে ধাবিত হলাম। 

 

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।