প্যারেন্টিং

প্যারেন্টিং ব্যাপারটা খূব সহজ কিছু না। আমি নিজে বিয়ে করি নাই, তাই ছেলে-মেয়েও নাই। কিন্তু আশেপাশে অনেক বাবা-মা’দের ছেলে-মেয়ে মানুষ করার ধরণ দেখলে মাঝে মধ্যে মনে হয় তাদেরই আগে মানুষ করি। কিন্তু সেটি আর করা হয় না। 

কিছুদিন আগে এক আত্মীয়ের ২ মেয়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গিয়েছিলো। একজন দশম শ্রেণীতে পড়ে, আরেকজন অনার্স পড়ে। প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছিলো ছোট মেয়ের সাথে এক ছেলের প্রেমের সম্পর্ক জানতে পেরে বাবা-মা তাকে শাসন করেছিলো। তারপরই ছোট মেয়ে বড় বোনকে নিয়েই ঘর ছাড়ে। বড় মেয়েরও একজন পছন্দের মানুষ ছিলো। বাবা-মা’কে সেটা জানিয়ে ছিলো। অবশ্য বাবা-মা সঙ্গত কারণে সেই ছেলের সাথে সম্পর্ক করতে রাজি ছিলেন না। আমরা শুরুতে এরকম ভাষ্য পেয়েছিলাম পরিবারের কাছ থেকে। 

পরে মেয়েদের মুখে পুরো ঘটনা শুনে আমরা রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মেয়েদের বাবা’র রাগ খূব বেশী, কিছু হলেই তিনি রেগে যান। শাসন করতে গিয়ে এতো বড়ো মেয়েদের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করেন না। বাসা থেকে আত্মীয়দের বাড়ী বেড়াতে যেতেও বাধা দেন। আরো নানারকম বিধি-নিষেধ আরোপ করে রেখেছেন মা-মেয়েদের উপর। 

মেয়েরাও এতো সব বিধি-নিষেধের জাল ভেদ করতে নানারকম কান্ড করে। বড় মেয়ে কয়েক বছর আগে ফোনে স্বল্প পরিচিত এক ছেলের সাথে ঘর ছেড়ে বিশাল এক বিপদে পড়তে যাচ্ছিলো। সৌভাগ্যক্রমে মেয়েটিকে তারা দ্রুতই উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। এই মেয়েটি খূবই সরল সোজা টাইপের। অন্যদিকে ছোট মেয়ে ধারণার চাইতেও বেশী চালাক, চরম ধরণের জেদী এবং মিথ্যা বলায় অনেক পারদর্শী। সেই সাথে আছে অভিনয় দক্ষতা।

বাবার অতি রাগের বিপরীতে মা কিছুটা বেসামাল। সেও প্রচুর মিথ্যা বলে এবং মেয়েদের অনেক কথাই বাবা’কে জানায় না। বাবাও এমন চিজ সে নিজে কোন (পারিবারিক) কাজ করবে না, সব কাজের দায়িত্ব মা এর। যেমন নবম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় ছোট মেয়ে নয় বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছিলো। তার প্রমোশন হতো না। কিন্তু মা শিক্ষকদের হাতে পায়ে ধরে তাকে দশম শ্রেণীতে প্রমোশন দেয়ায়। অথচ বাবা’কে এর বিন্দু বিসর্গও জানায় নাই। এক প্রতিবেশী ছোট মেয়ে’কে অচেনা ছেলের সাথে স্কুল টাইমে বাইরে দেখে মাকে জানায়। মা উল্টো তার সাথে ব্যাপক দূর্ব্যবহার করে। এরকম আরো অনেক ঘটনা আছে। বাবার এসব অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মা দুই মেয়ে’কে নিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলো একবার। বাবা বাসায় এসব অশান্তির সময় নিজের মায়ের সাথেও অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করে। একবার নাকি টিভি তার গায়ের উপর ফেলে দিয়েছিলো। 

এতোসব কারণে মেয়েরা মনে করেছিলো বাসা হলো জাহান্নাম, বাইরে বের হতে পারলেই বেহেশত। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ ভাল। বাড়ী-গাড়ী আছে, মেয়েরা না চাইতেই অনেক কিছু পায়। তারপরও বাবার রাগ, শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচারের কারণে এবং আশেপাশের আত্মীয়-স্বজন / বন্ধু-বান্ধবদের দেখে তাদের মনে হয়েছে “ঐ পাড়েতে সর্ব সুখ” বিদ্যমান।

যাই হোক। শেষ পর্যন্ত বড় মেয়ে’কে বাসায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে আর ছোট মেয়েকে সেই ছেলের সাথেই বিয়ে দেয়া হয়েছে। যদিও এই বিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আমার দ্বিমত ছিলো বরাবরই। আমি চেয়েছিলাম ছেলে-মেয়ে দু’জনেই যার যার বাসায় ফিরে গিয়ে পড়শোনা করবে, সমঝোতার ভিত্তিতে ৫/৬ বছর পর তাদের বিয়ে হতে পারে। কিন্তু আবারও বাবা-মায়ের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এই বয়েসে তাদের বিয়ে হলো। ঠেলে এবার এইচএসসি দিবে, আর মেয়ে পড়ে দশম শ্রেণীতে – এটা একটা বিয়ের বয়স হলো !?!

মেয়েরা বাসা থেকে বের হওয়ার একদিন পর ঘটনা জেনে আমি তাদের মেসেজ দিয়েছিলাম ফিরে আসার জন্য। সাথে এও বলেছিলাম প্রয়োজনে আমি গিয়ে তাদের নিয়ে আসবো। বড় মেয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করে দুপুরে, আমি নিজ দায়িত্বে তাদের (২ বোন + ছেলে) বাসায় (আমার বোন-দুলাভাই এর বাসা আসলে) নিয়ে আসি। তারপর থেকেই আমাকে নানা কথা শুনতে হচ্ছিলো নানা দিক থেকে। আমি কেন তাদের বাসায় নিয়ে আসলাম, মেয়েদেের না হয় এনেছি – ছেলেকে কেন আনলাম, মেয়ের বাবার সাথে কেন যোগাযোগ করলাম না ইত্যাদি ইত্যাদি। আার একটাই কথা ছিলো – আমি মেয়েদের সিকিউরিটির কথা আগে ভেবেছি। রাস্তাতেই ছোট মেয়ে জেদ করছিলো তার সাথে ছেলে যাবে, নাহলে সে যাবে না। আবার বাসায় নিয়ে ছেলে’কে কিছু বলা যাবে না। এই মেয়ের জেদ সম্পর্কে আমি জানতাম, সেই সাথে তার সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি আছে সেটাও জানতাম। তাই আমি রাস্তায় কোন বাগবিতন্ডায় না জড়িয়ে সোজা বাসায় নিয়ে এসেছিলাম। শুরুতে মেয়ের পরিবার আমার সাথে এমন ব্যবহার করে যাতে মনে হচ্ছিলো আমি বিশাল অপরাধ করে ফেলেছি। তারা সাফ জানিয়ে দেয় এই মেয়েদের তারা ঘরে ফেরত নিবে না। তাদের অসহযোগীতায় কারণে মেয়েরা এই বাসাতেও থাকতে চাইছিলো না। তারা অবশ্য জানিয়েছিলো তারা আগের রাতে একটি গার্লস হোষ্টেলে ছিলো, সেখানেই তারা যাবে। আমি কোনভাবেই তাদের কনভিন্স করতে পারি নাই। শেষতক তারা আমাকে জানায় তারা সকালেই চলে আসবে আবার। আমি অনেকটা নিরুপায় হয়েই তাদের যেতে দেই। রাতে মেয়ের মা ফোন করে জানায় তারা সকালেই আমাের বাসায় চলে আসবে এবং ছেলে-মেয়ে’কে নিয়ে ঠেলের বাড়িতে যাবে, দুই পরিবারের বাড়ীই অন্য জেলায়। পরিবার যদি শুরুতেই নরম হতো তাহলে আমি মেয়েদের এই বাসায় রাখতে পারতাম। আবার পরিবার নরম হলেও মেয়ে আর নরম হয় নাই। সে ঘোষণা দেয় সে ছেলের বাড়ীতেই যাবে। তারপর যা হবার হবে। 

তারপর যা হওয়ার তাই হলো। ছেলে পক্ষও আপত্তি করে নাই। তাদের বাড়ীতেই বিয়ে হয়েছে। পরে জামাই-বৌ’কে রেখে মেয়ের পরিবার বড় মেয়ে’কে নিয়ে তাদের বাড়ীতে ফিরে যায়। 

আমি খূব বাজে ধরণের মধ্যস্থতাকারী নিঃসন্দেহে। তবে আমি দেখতে চাই এখন মেয়ের পরিবার কি করে। আগেই বলেছি মেয়ের বাবার অঢেল আছে। সে তুলনায় ছেলের পরিবার ধারে কাছেও নাই। ছেলের বাবা মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করে। তাদের পরিবারের বেশীরভাগ পূরুষই মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী। শত অত্যাচার-অবিচারের মধ্যেও মেয়ের যে লাইফ ষ্টাইল ছিলো, তা ছেলের পরিবারের সাথে যায় না। যদিও মেয়ের মা পরে আমাকে জানিয়েছে তাদের ব্যবহার অত্যন্ত অমায়িক ছিলো। ছেলের মা ছেলে এবং মেয়েকে পড়াবেন বলে নিশ্চয়তা দিয়েছেন। সবকিছুই ভেস্তে যেতে পারে যদি মেয়ে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হতে না পারে এবং মেয়ের বাবা অহেতুক মেয়ের এই জীবনযাত্রায় নাক গলায়। 

যা ঘটেছে সেটি অনেকটা মন্দের ভাল। সব কিছুই এখন ভবিতব্য।

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।