মরিসের সাথে প্রথমে গেলাম এক পোষ্ট অফিসে। পথে মরিস জানালো এখানে ক্লিনিং এর কাজ করতে হবে, আপাতত এর চাইতে ভাল কিছু জোগাড় করা গেলো না। আসছি টাকা কামাই করতে, সুতরাং কোন কাজেই আমার ‘না’ নাই। মরিস পোষ্ট মাষ্টারের সাথে কিছু আলাপ করলো, আমার সাথে কেবল হাই হ্যালো। পোষ্ট অফিস থেকে বের হয়ে গেলাম আরেক অফিসে। সেটা পোষ্টাল ডিপার্মেন্টের এক অফিস। সেখানে এক মহিলার সাথে কথা বললো মরিস। আমাকে কিছু ফর্ম দেয়া হলো পূরণ করার জন্য। এরপর আমাকে বললো পরের দিন আমাকে পোষ্ট অফিসে (যেটাতে প্রথমে গিয়েছিলাম) সকাল ১০টার দিকে উপস্থিত থাকতে হবে। সেখানে লুলু নামের একজন মহিলা আমাকে কাজ সম্পর্কে ব্রিফ করবেন।
পরদিন আমি উপস্থিত হলাম ১০টার বেশ আগেই। সুইডেনে পোষ্ট অফিস খুলে ৮টার সময়, কিন্তু সাধারণের জন্য সামনের দরজা খুলে ১০টায়। এই ২ ঘন্টা পোষ্ট অফিসের লোকজন অন্যান্য কাজ করে। সকাল ৮টায় আবার সবাই কাজে আসে না, অল্প কিছু। ১০টার মধ্যে বাকিরা চলে আসে। যারা আগে এসেছিলো, তারা অন্যদের চাইতে ২ ঘন্টা আগে ছুটি পায়। আমি গিয়ে দেখলাম পোষ্ট অফিস তখনও খুলে নাই। মানে সামনের দরজা। ওদের অফিসগুলোতে সাধারণত ৩টা দরজা থাকে। একটা পাশে অথবা পিছনে। এটি সাধারণত ষ্টাফদের জন্য। সামনের অংশে পর পর দুটি, দুই দরজার মাজের অংশটি অনেকটা ছোট একটি রুমের মতো। অনেক মার্কেটেও একই রকম ব্যবস্থা। ঠান্ডার দেশ বলে ভিতরে সবসময়ই হিটিং সিষ্টেম চালু থাকে। কেউ ঢুকতে বা বের হতে গেলে বাইরের ঠান্ডা অথবা ভিতরের গরম যাতে বেশী ঢুকতে বা বের হতে না পারে তাই এই ব্যবস্থা। ১০টা বাজেনি বলে প্রথম দরজা খোলাই ছিলো, দ্বিতীয় দরজা বন্ধ। বাইরের ঠান্ডা থেকে বাঁচতে আমি রুমের মতো অংশটায় গিয়ে দাড়ালাম। একসাইডে দেখি সারি সারি পোষ্টবক্স। ২/১ জন এসে বক্স খুলে চিঠিপত্র নিয়ে গেলো। হঠাৎ ভিতরের দরজা খুলে এক মহিলা এসে সুইডিশে কিছু বললেন। আমি ইংরেজীতে বললাম সুইডিশ বুঝি না। তখন মহিলা বললেন পোষ্ট অফিস খুলবে ১০টায়। আমি তাকে জানালাম লুলু নামে একজন আসবে যে আমাকে এখানে কিছু কাজ দেখিয়ে দিবে। মহিলা তখন আমাকে জানালো এব্যাপারে তাকে কেউ জানায় নি। সাথে এটাও বললো আমি ইচ্ছে করলে ভিতরে আসতে পারি। আমি ভিতরে গিয়ে বসলাম। এটি ছিলো পোষ্ট অফিসের সামনের অংশ, যেখানে গ্রাহকরা ঢুকতে পারে। একদিকে একসারি কাউন্টার। সামনের দরজার বিপরীত দিকে আরেক দরজা, ষ্টাফদের আসা যাওয়ার জন্য। রুমের এক পাশে একটি ফটোকপিয়ার, কয়েন অপারেটেড। কয়েন ফেলার নির্দিষ্ট অংশে কয়েন দিলে মেশিন চালু হয়। প্রতি কয়েনে ১বার ফটোকপি করা যায়। এটা অবশ্য জেনেছি ২দিন পর। বসার জন্য লম্বা চেয়ার আছে, পাশে ছোট চারকোণা টেবিল।
বসে আছি তো আছিই। ১০টা বেজে যাওয়ার পরও লুলু নামের মহিলার দেখা নাই। এর মধ্যে পোষ্টমাষ্টার চলে এসেছেন। আমার সাথে আলাপ হলো। জানলাম তার নাম ক্রিষ্টিনা। তিনিও জানালেন তাকে আমার আসার ব্যাপারে কেউ জানায়নি। লুলু আসলো ১৫/২০ মিনিট পর। এসেই এপোলজি, দেরী করে আসার জন্য। সাথে তার ২ ছেলে-মেয়ে। স্কুল ছুটি, তাই সাথে নিয়েই বের হয়েছে। আমাকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রথমে কোথায় কি আছে সেগুলো দেখানো হলো। এরপর শুরু হলো কি করতে হবে তা হাতে কলমে দেখানো। প্রথমে ঘর ঝাঁড়ু দিতে হবে, মানে ভ্যাকুয়াম ক্লিনিং। প্রথমেই সামনের অংশ। এরপর প্রতিটি কাউন্টার, কাউন্টারের গ্লাস মুছতে হবে। টেবিল এবং চেয়ার মুছতে হবে। গ্লাসের যে পার্টিশন আছে সেগুলো ২/৩দিন পর পর সাবান পানি দিয়ে পরিস্কার করতে হবে। কিভাবে করতে হবে সেগুলো সবই লুলু প্রথমে দেখিয়ে দিলো, তারপর আমাকে করতে হলো। সবশেষে ওয়েষ্ট পেপার বাস্কেটের সব ময়লা একটা বড় পলিথিনে ঢুকাতে হবে। একমাত্র ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ছাড়া সব কিছুই একটা ট্রলিতে থাকে, সেটা নিয়ে ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হয়। ভিতরেও একই ধরণের কাজ, তবে সেখানে কাউন্টারগুলোতে কিছু ফর্ম থাকে সেগুলো নিয়মিত এনে রাখতে হবে। ভাষা যেহেতু বুঝি না, ফর্মের লেখা দেখে এই কাজ করতাম। মাঝে মধ্যে গাছে পানি (ইনডোর প্ল্যান্) দিতে হবে। আমি যখন ভাবছি এতো চরম সহজ কাজ, সেসময়ই লুলু জানালো আমাকে প্রতিদিন ৪টা পোষ্ট অফিস ভিজিট করে এসব কাজ করতে হবে। এবং সকাল ১০টার মধ্যে কমপক্ষে ২টা পোষ্ট অফিস। মানে হলো প্রতিদিন ১০টার মধ্যে ২টা পোষ্ট অফিসের ফ্রন্ট সাইড ভাল মতো পরিস্কার করতে হবে। ভিতরে ভ্যাকুয়াম করতে হবে, ওয়েষ্ট পেপার বিন খালি করতে হবে, গ্লাসগুলো নরমালি পরিস্কার করতে হবে। বাকি দুটো পোষ্ট অফিস এরপর ধীরে-সুস্থে ভালো মতো ক্লিনিং করতে হবে। এর মধ্যে সপ্তেহে ২-৩দিন ঘর মুছতে হবে, বাইরের গ্লাসগুলি সাবান পানি দিয়ে ধূতে হবে। প্রতিদিন বের হওয়ার সময় পোষ্টমাষ্টারকে বলে যেতে হবে, আমি কতক্ষণ কাজ করলাম তার হিসাব রাখবেন তিনি। আরো একটা কাজ করতে হবে ক্লিনিং এ যেসব জিনিস লাগে সেসব সময় সময় চেক করে জানাতে হবে কোনটা কম আছে, কোনটা লাগবে। তবে আমি কেবল কি লাগবে সেটা পোষ্টমাষ্টারকে জানাতাম, তিনিই যথাস্থানে বলে দিতেন।
এই পোষ্ট অফিসের কাজ শেষ করে লুলু’র সাথে বের হলাম পরবর্তী পোষ্ট অফিসে যাওয়ার জন্য। লুলু নিজের গাড়ী নিয়ে এসেছিলো। পথে লুলুর সাথে অনেক আলাপ হলো। বাংলাদেশ নামটা কেবল জানে, আর কিছু না। যথা সম্ভব ওর প্রশ্নের জবাব দিলাম। ওর প্রশ্ন ছিলো বাংলাদেশের মহিলাদের নিয়ে, তারা কি সুইডেনের মহিলাদের মতোই জীবন যাপন করে কিংবা তারা কি গাড়ী চালায়। উত্তর দেয়ার পাশাপাশি আমিও টুকটাক প্রশ্ন করছিলাম। সুইডনে এসে যে জিনিসটা রীতিমতো চোখে পরেছিলো সেটা হলো মেয়েদের ধূমপান। মেয়েদের একটা বড় অংশই ধূমপান করে, সে তুলনায় ছেলেরা অনেক কম। লুলুও ধূমপান করে, আমাকে বলে গাড়ীতেই সিগারেট ধরিয়েছিলো। আমাকে আগে প্রশ্ন করলো তোমার দেশের মেয়েরা কি ধূমপান করে। আমি উত্তর দিলাম জনসম্মুখে কেউ করে না, একেবারে ওয়ার্কিং ক্লাস ছাড়া। মেয়েদের ধূমপান বাংলাদেশে কেউ ভালো চোখে দেখে না। এই কথা শুনে লুলু একটু দোটানায় পরে গেলো আমি তার সম্পর্কে কি ভাবছি তা নিয়ে। আমি বললাম চিন্তা করো না, আমি খারাপ কিছু ভাবছি না। এক এক দেশের এক প্রথা। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম সুইডেনের মেয়েদের সিগারেট আসক্তি এতো বেশী হওয়ার কারণ কি, ছেলেদের তো খূব বেশী ধূমপান করতে দেখি না। লুলু একটু চিন্তা করে বললো মেয়েদের আসলে অনেক কিছুর লোড নিতে হয়, তাই হয়তো। ব্যাখ্যা করলো এভাবে সে এবং তার হাজবেন্ড দু’জনেই চাকরি করে। অফিসের পর রান্না, ছেলে-মেয়েদের খোজখবর করা সবই মেয়েরা করে। আমি অবাক হয়ে বললাম আমার তো ধারণা ছিলো ইউরোপের ছেলেরা মেয়েদের মতোই সব কাজ ভাগাভাগি করে নেয়। উত্তরে লুলু বললো কিছু কিছু শেয়ার করে এটা ঠিক, কিন্তু বেশীর ভাগই মেয়েদের দায়িত্ব। যেমন ধরো আমার হাজবেন্ড, সে মোটামুটি নবাব ধরণের। অফিস থেকে বাসায় ফিরে আমি যখন রান্না আর ছেলেমেয়েদের খোঁজখবর করছি, তখন সে টিভি ছেড়ে সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছে। কোনদিন বলার পরে হয়তো একটু নড়াচড়া করে। ওর কথা শুনে হাসলাম বেশ। লুলুর মেয়ের সাথেও টুকটাক কথা হলো। কি পড়ে, ক্লাসে কি পড়ানো হয় এসব। ছেলে ছোট, খূবই লাজুক (হয়তো ইংরেজীতে কথা বলার জন্য)। আমাকে কেবল নিজের নাম বলেছিলো।
এভাবে এক এক করে বাকি ৩ পোষ্ট অফিসে গেলাম। পোষ্ট মাষ্টারদের সাথে আলাপ হলো। প্রতিটি পোষ্ট অফিসে মেয়েদের প্রাধান্য। এক আধজন ছেলে। তবে এলতায় যে বড় পোষ্ট অফিস ছিলো সেখানে সর্টিং সেন্টারে পূরুষ পোষ্টম্যান ছিলো বেশ কয়েকজন। এখানে বলে রাখা ভালো সব পোষ্ট অফিস থেকে কিন্তু চিঠিপত্র বিলি হয় না। আমি যে ৪টি পোষ্ট অফিসে কাজ করেছিলাম তারমধ্যে কেবল এলতার পোষ্ট অফিস থেকেই চিঠি বাসায় বাসায় বিলি করা হতো।
প্রথমদিন কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে একটু দেরীই হয়েছিলো। তারপর সারাদিন ঘুরেছি লুলুর গাড়ীতে পরদিন ঠিকমতো সব চিনতে পারবো কিনা একটু টেনশনে ছিলাম। লুলু প্রতিবারই আমাকে কাছের বাস ষ্টেশন চিনিয়ে দিচ্ছিলো।
অবশেষে বাসায় ফিরলাম। পোষ্ট অফিস অধ্যায় শুরু হলো।
ফেসবুক মন্তব্য