ষ্টকহোম ডায়েরী (১৯)

উভের কথা তো অনেক হলো, এবার অন্যদের কথা কিছু বলি। উভের পরে যার নাম আসবে তিনি হলেন ক্রিষ্টিনা। আমি প্রথম যে পোষ্ট অফিসে গিয়েছিলাম এবং লুলু আমাকে যেখানে প্রথম দেখিয়ে দিয়েছিলো কি ভাবে কি করতে হবে, ক্রিষ্টিনা সেই পোষ্ট অফিসের পোষ্টমাষ্টার। আমি যে কোন প্রয়োজনে উভে এবং ক্রিষ্টিনাকে বলতে পারতাম সাহায্যের জন্য। তারাও আমাকে যথেষ্ঠ’রও বেশী সাহায্য করেছেন। ক্রিষ্টিনা অবশ্য মাঝে মধ্যে বকা দিতো আমি কেন দ্রুত সুইডিশ শিখছি না তার জন্য। দেখা যেতো টুটা-ফাটা সুইডিশ দিয়ে হয়তো কথা শুরু করলাম, এক আধটা বাক্য বলে দেখা যেতো দম শেষ। তারপর ইংরেজী, তারাও প্রত্যেকেই ভাল ইংরেজী বলে। ফলাফল আমার সুইডিশ শেখা যে তিমিরে ছিলো সেই তিমিরেই রয়ে গেলো। 

ভাষা শেখার কথা যখন এসেই গেলো এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা বলি। ভাষা শেখার জন্য বাসা থেকেও বার বার বলা হচ্ছিলো। সাধারণত যারা ২ বছর বা তার বেশী সময়ের জন্য সুইডেনে যায়, তাদের জন্য ভাষা শিক্ষা ফ্রি। বাকিরা শিখতে চাইলে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টাকার বিনিময়ে কোর্স করতে পারে। উভে আমাকে ২/৩টি এরকম ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা জোগাড় করে দিয়েছিলো। সবগুলিই আমার যাওয়া আসার পথের মধ্যেই পরে। একদিন খূজে পেতে এরকম একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে হাজির হলাম। সবকিছু শুনে সেখানেই ভর্তি হয়ে গেলাম। ক্লাসের সময়ও বলে দেয়া হলো। পরের সপ্তাহে নির্ধরিত দিনে গিয়ে হাজির হলাম। ক্লাস ছিলো সন্ধ্যার দিকে। কাউকেই তো চিনি না। রিসেপশন থেকে বলা হলো অমুক রুমে ক্লাস হবে। গিয়ে দেখি কয়েকজন চলে এসেছে। আমি জাষ্ট হেই বলে ঢুকে পড়লাম। টুকটাক কথাবার্তাও শুরু করেছে কেউ কেউ। ইংরেজী ছাড়া আরো কিছু ভাষা শোনা শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণ পর ছোটখাট একজন মহিলা এসে একেবারে সামনে চলে গেলেন। কথা বলা শুরু করলেন বিশুদ্ধ সুইডিশে। সবাই এ ওর মূখের দিকে তাকাচ্ছি। কারণ কেউ ই তেমন কিছু বুঝতে পারছিলাম না। নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রেখে মহিলা এবার ইংরেজীতে বললেন। নাম বলেছিলেন, এখন আর মনে নেই। বললেন তিনি বুলগেরিয়া থেকে এসেছেন, বর্তমানে সুইডিশ নাগরিক। তিনিই আমাদের সুইডিশ ভাষা শিখাবেন এবং সেটি সুইডিশেই। তাই আমরা যেন কথা শোনার দিকে জোর দেই। তাতে সব কথা হয়তো বুঝবো না, কিন্তু অনেকটাই বুঝতে পারবো। এভাবে নাকি দ্রুত কোন ভাষা শেখা যায়। সুইডিশ দিয়ে সুইডিশ শেখানোর কথায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলো। যাই হোক। এবার পরিচয়ের পালা। দেখা গেলো কয়েকজন এসেছে আমেরিকা থেকে। কিছু আছে ইউরোপিয়ান। আফ্রিকান ছিলো আর ছিলাম আমি। আমেরিকান মেয়ে ছিলো ২/৩ জন, তারা এসেছে ন্যানি হিসেবে। আমি অবশ্য তখনও জানি না ন্যানি’র কাজ কি। ২ জন আমেরিকান ছেলে ছিলো তারা আমেরিকান কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে এসেছে। ইউরোপ থেকে ২ জন মেয়ে ছিলো, একজন ফ্রান্সের আরেকজন অধূনালুপ্ত চেকোস্লোভাকিয়ার। আরেকজন ছেলে ছিলো স্পেনের। একজন কালো আফ্রিকান ছেলে ছিলো, তবে সে কোন দেশের মনে নেই। তবে সে ভালই সুইডিশ পারতো। আমাদের সাথে কেন শিখতে এসেছিলো সেটি অজ্ঞাত। আলজেরিয়ার এক ছেলে ছিলো, মুসলিম। ফ্রান্স আর চেকোস্লোভাকিয়ার মেয়ে দু’টো ছিলো প্রচন্ডরকম নাক উচা। তাদের দুইজনের আবার ভাল মিল হয়ে গিয়েছিরো, কারণ দুইজনেই কম বেশী জার্মান জানে। কালো আফ্রিকান ছেলেটাও একটু ডাট মারতো। সবসময় স্যুটেড-বুটেড হয়ে আসতো। এদিক দিয়ে আমেরিকান ছেলে-মেয়ে গুলি দিলখোলা। একজন ছিলো কালো আমেরিকান, একমাত্র তার ইংরেজী বুঝতেই একটু সমস্যা হতো। ওর সাথে কথা বলতে গেলে সবসময়ই বলতাম ধীরে বলো।

আমেরিকান মেয়েগুলির কাছ থেকেই জানলাম তারা ন্যানি, মানে বাচ্চার দেখাশোনা করে। সুইডিশ ফ্যামিলি’র সাথে ৩ মাস থাকার জন্য এসেছে। মূল কাজ আসলে বাচ্চাদের সাথে ইংরেজীতে কথা বলা, যাতে বাচ্চাদের ইংরেজীতে কথা বলার জড়তা কেটে যায়। এর বাইরে বাচ্চাদের মা’কে এক আধটু সাহায্য করা। বিনিময়ে ৩ বেলা খাবার, থাকার জায়গা এবং সাপ্তাহিক একটা হাত খরচ। ইউরোপ আমেরিকায় এই বিষয়টি নাকি ভালই জনপ্রিয়। গ্রীষ্মে পড়াশোনার অবসরে অনেকেই এভাবে কোন দেশ দেখতে বের হয়। কাজও করলো, কিছু পয়সাও আসলো পকেটে। সেই সাথে থাকা-খাওয়া ও জুটতেছে। আমি পরে গ্রীষ্মে আর কি কি কাজ করে ইউরোপ আমেরিকার ছেলেমেয়েরা সে সংক্রান্ত কিছু বইও জোগাড় করেছিলাম।

আমেরিকান ছেলে দু’জনই এসেছিলো কোন আমেরিকান কোম্পানির জিনিসপত্র বিক্রির জন্য। স্পেনের ছেলে চলে এসেছিলো তার সুইডিশ বান্ধবীর টানে। বান্ধবীর সাথেই থাকে, বান্ধবিই তাকে চালাচ্ছে। আমি পোষ্টঅফিসে কাজ করি শুনে সে খূব আগ্রহী হয়ে উঠেছিলো কিভাবে কাজ পাওয়া যায় জানার জন্য। সব শোনার পর সে খূব আশাহত হয়েছিলো। জিজ্ঞেস করেছিলাম সে রেসিডেন্সি পেয়েছে কিনা, জানালো তার বান্ধবী এপ্লাই করেছে। তবে তার অভিযোগ ছিলো সুইডেনের ঠান্ডা আবহাওয়া নিয়ে। আমার ধারণা ছিলো ইউরোপের সব দেশেই ঠান্ডা, কম আর বেশী। কিন্তু স্পেনের সেই ছেলে বললো সে স্পেনের যে অংশে থাকে সেখানে কাঁঠ ফাটা রোদ। সুইডেনের এই ঠান্ডা তার সহ্য হচ্ছে না। আমি হাসতে হাসতে বললাম সামনে যে শীতকাল আসতেছে কি করবা। ছেলের উত্তর কম্বল নিয়ে ঘুরবো।

সবশেষে বলতে হয় আহমেদ এর কথা। আলজেরিয়ার ছেলে। রাজনৈতিক কারণে দেশান্তরি। এর আগে আরো দুই ইউরোপিয়ান দেশে থেকে এসেছে। কাগজপত্র নিয়ে ঠিক সূবিধা করতে না পারায় এবার সুইডেনে। পোষ্ট অফিসের চাকরির ব্যাপারে সেও জানতে আগ্রহী ছিলো। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম সে চলে কিভাবে, মানে থাকে কোথায়, কি কাজ করে। পরে বলবে বলে পাশ কাটিয়ে গেলো। আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করি নাই। কয়েকদিন পর সে নিজেই প্রসঙ্গ তুললো। বললো শুরুতে তারা ৫ জন পরিচিত এক দেশী লোকের বাসায় ছিলো। কিন্তু ৫ জন, সাথে বাড়ীর মালিক একজন মানে ৬ জন এক ফ্ল্যাটে থাকা খূবই কঠিন। তাই তারা পালাক্রমে থাকতো। মানে তিনজন হয়তো বাসায় থেকে ঘুমায় বা রান্না করে। বাকি দুই জন ঘুরে বেড়ায়। এভাবে চলছে জীবন। দেশ থেকে কিছু টাকা পয়সা আসে, তা দিয়েই চলছে। সুইডেনে অবশ্য লুকিয়ে থাকার কোন সূযোগ ছিলো না। আর কেউ না জানুক পুলিশ অবশ্যই জানার কথা। রাজনৈতিক কারণে দেশ ছাড়া বলে আমি আর বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসা করি নাই। তবে আহমেদ থাকতো এক সুইডিশ মহিলার সাথে। সে কাহিনী বড় বিচিত্র। আহমেদ আর তার এক বন্ধু গিয়েছিলো কোন এক ডিস্কোতে। আলজেরিয়ার ভাষা আরবি এবং ফ্রেঞ্চ। তাদের ফ্রেঞ্চ কথোপকথন শুনে এক মধ্যবয়সী মহিলা এগিয়ে এসে পরিচিত হয়। সে নাকি বেশ আগে ফ্রেঞ্চ শিখেছিলো, কিন্তু চর্চার অভাবে ভুলতে বসেছে। আহমেদ আর তার বন্ধু সানন্দেই ফ্রেঞ্চে মহিলার সাথে আলাপ করে। কথা প্রসঙ্গে মহিলা আহমেদ এর হালহকিকত জেনে নেন। ফেরার পথে আহমেদকে বলেন সে ইচ্ছে করলে তার ফ্ল্যাটে চলে আসতে পারে। সেই থেকে আহমেদ এই মহিলার সাথেই। আমি এই গল্প শুনে হাসতে হাসতে বললাম তোমার দোষখে যাওয়া তো কেউ ঠ্যাকাতে পারবে না। আহমেদ ও হাসতে শুরু করলো আমার কথায়। জিজ্ঞাসা করলাম আলজেরিয়ায় কিভাবে দেখবে লিভ টুগেদার ? বলে জানলে আর নাগাল পেলে সোজা শুট করবে আমার পরিবার।

সুইডেনে এই এক জীবন। সাধারণ মানুষজন যখন যৌবন থাকে যে যার মতো জীবন উপভোগ করে। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। বিয়ে করা বা ঘর বাঁধার কথা কেউ চিন্তাই করে না। বয়স বাড়তে থাকলে একসময় মেয়েরা স্থায়ী সম্পর্কের দিকে যাওয়ার চিন্তা করে, ছেলেরা চিন্তা করে আরো পরে। এক বাঙ্গালী ছেলে উপদেশ দিয়েছিলো যদি সুইডেনে স্থায়ী হতে চান কখনই কম বয়েসী মেয়ের দিকে নজর দিবেন না। মোটামুটি বয়স ৩০ এর কাছাকাছি এমন মহিলা পছন্দ করেন খূব সহজেই সম্পর্ক তৈরী হয়ে যাবে। কথা হলো এসব নিয়ে ভাবার মতো সময় বা পরিস্থিতি কোনটাই ছিলো না।

আজ এ পর্যন্তই। ভাল থাকবেন। 

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।