ষ্টকহোম ডায়েরী (২০)

একদিন ক্লাসে গিয়েছি, হয়তো একটু আগেই চলে গিয়েছিলাম। ক্যাফেটারিয়ায় এক ক্যান কোলা (কোকাকোলা) কিনে ঢুকতেই দেখি দুই আমেরিকান বসে গল্প করছে। আমাকে দেখেই হাত নাড়লো। আমিও গিয়ে বসলাম তাদের সাথে। হাই হ্যালোর পর ছেলেটিই প্রথম জিজ্ঞাসা করলো তুমি তো বাংলাদেশ থেকে এসেছো, তাই না ? বললাম হ্যাঁ। আশা করি তুমি জান এই দেশ কোথায়। বলার সময় একটু হাসছিলাম। ছেলেও হেসে বললো স্কুলে আমাদের ভূগোল পড়ানো হয়েছে। অনেক কিছু না জানলেও এই দেশ কোথায় সেটা জানি। বললাম বাংলাদেশ অনেকেই চিনে না তো, তাই বললাম। এক মহিলা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো বাংলাদেশ কি আফ্রিকার কোন দেশ। এরপর টুকটাক আলাপ চললো, ওরা কোন ষ্টেটের অধিবাসী, কি কাজ করে, আমি কিভাবে এলাম, কি কাজ করি এইসব আর কি। কথা বলতে বলতে বিষয় চলে এলো কালচারাল শক। অনেক কিছুই হয়তো জানতাম, কিন্তু এখানে অনেক কিছুই নতুন করে বুঝতে হচ্ছে, ভাবতে হচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে বললাম রাস্তা ঘাটে গভীরভাবে চুমু দেয়া কিংবা লিভ টুগেদার ইত্যাদি। আমার কথা শেষ হতে না হতেই মেয়েটি বলে বসলো সুইডিশরা মারাত্মক অসভ্য। তাদের লজ্জা-শরম মনে হয় খূবই কম। আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম এ কথার মানে কি ? রাস্তা ঘাটে চুমু দেয়ার কথা বললে না, এই জন্য বললাম। আমি হাসতে হাসতে বললাম আমেরিকায় কি তোমরা রাস্তাঘাটে চুমু দাও না ? মেয়ের ত্বরিত জবাব দেই। কিন্তু এরা যেরকম এগ্রেসিভলি রাস্তাঘাটে চুমু দেয়, সেভাবে কখনই না। সেগুলো সব ঘরের ভিতর। আমি হাসতে হাসতে তখন আমার বাস যাত্রার সময় যে অভিজ্ঞতা হয়েছিলো এখানে আসার পর পরই সেটা বললাম। আলাপা আলাপে বুঝলাম আমেরিকার লোকজন ইউরোপিয়ান লোকজনের চাইতে কিছুটা কনজারভেটিভ। ক্লাসের সময় হয়ে গিয়েছিলো, তাই সেদিনের মতো আলাপ সাঙ্গ হলো।

আমি ঢাকায় সাধারণত ফোন করতাম রাস্তার পে ফোন থেকে। আগে যেটাকে আমরা বলতাম কয়েন বক্স ফোন। স্লটে কয়েন ফেললে ডায়াল টোন পাওয়া যেতো, তখন ফোন করতে হতো। মিনিট পাঁচেক পর লাইন কেটে যেতো। ঢাকায় ফোন করলে সাধারণত অনেক কয়েন নিয়ে ফোন বুথে ঢুকতাম আর কিছুক্ষণ পর পর কয়েন ঢুকাতাম। এতে করে লাইন কাটতো না। আমি তাই পোষ্ট অফিসের আশে পাশের ফোন বুথ গুলি ব্যবহার করতাম, যাতে পোষ্টঅফিস থেকে দ্রুত চেঞ্জ করা যায়।

এরকম একদিন ঢাকায় ফোনে কথা বলছি। কয়েন শেষ হয়ে যাওয়ায় লাইন কেটে গেলো। আমি আবার ঢুকলাম পোষ্টঅফিসে, টাকা ভাঙ্গানোর জন্য। কাউন্টারে দেখি একা আনিতা বসে আছে। প্রায় বিকাল বলে হয়তো কোন কাষ্টমারও নেই। আনিতা চোখ নাচিয়ে বললো এতো কয়েন দিয়ে কি করবা ? বললাম দেশে ফোন করতেছি। কল সেরে আসতেছি। আনিতার সাথে মাঝে মধ্যেই আলাপ হতো বিভিন্ন বিষয়ে।

ফিরে এসে দেখি তখনও আনিতা বসে আছে। কিছুক্ষণ পর ছুটি হবে। এই কথা সেই কথার পর সে আমার ভাষার শেখার উন্নতি সম্পর্কে জানতে চাইলো। বললাম খূব বেশী আগাতে পারছি না। কারণ সুইডিশরা সবাই বেশ ভাল ইংরেজী বলে, ঠেকে গেলে আমিও ইংরেজীতে কথা বলে ফেলি। আনিতা সাথে সাথে বললো আমার সাথে প্র্যাকটিস করতে পারো। আমিও সূযোগ পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম তুমি একা না বিবাহিত। সেও আবার চোখ নাচিয়ে বলে বিবাহিত না, তবে বয়ফ্রেন্ড আছে। ওর বলার ভঙ্গি দেখে আমিও হেসে ফেললাম। ও নিজে থেকেই তখন বললো গত ৭ বছর ধরে ওরা একসাথে আছে। জিজ্ঞাসা করলাম বাচ্চা নিয়েছো ? বলে এখনই না। আমি তখন একটু ইতস্তত করে বলেই ফেললাম আমি আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই, যদি তুমি অনুমতি দাও। আনিতা সাথে সাথেই বললো বলে ফেলো, কোন ব্যাপার না। জিজ্ঞেস করলাম তুমি এই যে ৭ বছর ধরে একসাথে আছো, ভবিষ্যতে হয়তো বাচ্চাও নিবে। তাহলে বিয়ে করছো না কেন ? আমার কথা শুনে দেখি মেয়ের চোখ গোল গোল হয়ে গেছে। এরপর শুরু হলো হাসি। হাসতে হাসতে বললো এটা তুমি কি প্রশ্ন করলা। আমিও বললাম আমার দেশে লিভ টুগেদার তো নাই ই। প্রেম হলেও বাবা-মায়ের সম্মতিতে বিয়ে, তার আগে কোন ধরণের ফষ্টি-নষ্টি নয়। আনিতা তখন বলে যদি পার্টনারের উপর থেকে মন উঠে যায় তাহলে কি তোমার সেই এক টুকরো বিয়ের কাগজ সম্পর্ক ধরে রাখতে পারবে ? প্রতিদিন ঝগড়াঝাটি করে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কোন মানে হয় না। এবার সে সিরিয়াস মুখ করে জানতে চাইলো বাংলাদেশে কি ডিভোর্স নাই ? বললাম আছে। তবে কম। বেশীর ভাগ পরিবার ডিভোর্স এড়াতে চায়, বিশেষ করে বাচ্চা থাকলে তারা নিজেদের সব বৈরীতা সত্বেও একসাথে থাকার চেষ্টা করে। অনিতা এবার হাসতে হাসতেই বললো তোমাদের চিন্তাভাবনা আর আমাদের চিন্তা ভাবনা যোজন যোজন তফাত। আমিও মাথা নেড়েই বললাম আসলেই তাই।

বিয়ে / লিভ টুগেদার প্রসঙ্গে আরেকদিন ভরা মজলিসে আলাপ হয়েছিলো। জিজ্ঞেস করেছিলাম এশিয়ান দেশ গুলির মতো সম্পন্ধ করে বিয়ে হয় নাকি। এক মেয়ে হাসতে হাসতে বললো প্রাগৈতিহাসিক আমলে হতো। আরেকজন বললো এশিয়ান ইমিগ্র্যান্টরাই এখনো সম্পন্ধ করে বিয়ে করে। তার এক প্রতিবেশীর এরকম বিয়েতে সে উপস্থিত ছিলো। মজলিশে এঞ্জি নামে এক মেয়ে ছিলো, যার বয়স খূব বেশী হলে ২০ বছর। দেখতে খূবই সুন্দর। দেখার মতো জিনিস ছিলো ওর সোনালি চুল। পুরোটাই ধরতে গেলে সোনালী, কিছু কিছু জায়গায় কালো। এতে আরো বেশী সুন্দর লাগতো। ও ছিলো সিঙ্গেল মাদার। ও নিজে থেকেই বললো সুইডেনে বিয়ে এখন খূবই কম। ছেলেরা বিয়ে করতে দ্বিধা করতো বলে এই লিভ টুগেদার ব্যবস্থা চলে এসেছে। জিজ্ঞাসা করলাম ছেলেদের এই দ্বিধা তৈরী হলো কি করে। আরেকজন উত্তর দিলো বিয়ের পর ডিভোর্স হলে ছেলেদের অর্থনৈতিক দন্ড বেশী দিতে হয়। তারপর বাচ্চা থাকলে তার ভরনপোষন তো আছেই। আমি তখন জিজ্ঞাসা করলাম তো লিভ টুগেদার এ বাচ্চা হলে তার দায়িত্ব কার ? এঞ্জি উত্তর দিলো এখানে প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। যেহেতু মেয়েরাই বাচ্চা পেটে ধরে তাই দায়িত্ব বোধ তাদেরই বেশী, ইচ্ছে করলেই বাচ্চা ফেলে চলে যাওয়া যায় না। তার মেয়ের কথা বললো বয়ফ্রেন্ডের সাথে আলাদা হওয়ার পর সে একাই আছে মেয়ে নিয়ে। নিজে চাকরি করছে, মেয়ের সরকারী ভাতা আছে। সমস্যা হয় না। কাজের সময় এক ডে কেয়ার সেন্টারে রেখে আসে মেয়েকে। মেয়ের বাবা অবশ্য খূব একটা খোজ খবর নেয় না। তবে মেয়েকে দেখতে চাইলে সে না করবে না। 

আসলেই ওদের চিন্তা ভাবনা আর আমাদের চিন্তা ভাবনায় অনেক বেশী ফারাক।

 

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।