হন্টন (৪)

সেদিন বাসা থেকে বের হলাম ১২টার দিকে। মূল গন্তব্য বাংলা একাডেমির বইমেলা। তবে, আপাত গন্তব্য ছিলো বনানী। ইচ্ছা ছিলো পুরো পথটাই হেটে যাব। কিন্তু অনেকদিন পর লম্বা পথ হাটবো বলে আপাতত তাই বনানী পর্যন্ত হেটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বনানী পৌছে যদি শরীরে কুলায় তবে বাকি পথও হেটে যাব।

বাসা থেকে হেটে প্রথমে গেলাম রাজলক্ষী। ওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তার ওপারে গিয়ে ধীরে সুস্থে হাটতে থাকলাম। বেশ কিছু জায়গায় ফ্লাই ওভার এর কাজের জন্য ফুটপাত এবং সংলগ্ন ড্রেনের কাজ চলছে। এসব জায়গায় একটু ধীরে এবং সাবধানে হাটতে হচ্ছিলো। পাশ দিয়েই গাড়ী চলছিলো। একদম ভরদূপুর বলে গাড়ীর সংখ্যা কম। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সামনে ফুটপাত তৈরী হয়ে গেছে। চওড়ায় বেশ বড়। এখন বাকি পথের ফুটপাত এমন চওড়া করে তৈরী হলে বেশ ভালই হবে। তবে মোটর সাইকেল আরোহীরা যে এটাকে বাইক লেন বানাবে না তার নিশ্চয়তা নাই। পুরো রাস্তায় যেখানে যেখানে ফুটপাত নাই, সেখানে গাড়ী চাপার ভয় পাই নাই, পেয়েছি মোটর সাইকেল এর নিচে পড়ার ভয়। কিছু কিছু মোটর সাইকেল আরোহী অহেতুক বাম দিকে চেপে আসছিলো, অথচ আমার বাম দিকে চাপার কোন সূযোগ ছিলো না। ৩/৪ ফিট দুর দিয়ে হয়তো গাড়ী যাচ্ছে একটা, হঠাৎ দেখা গেলো এক মোটর সাইকেল তীব্র বেগে সেই ৩/৪ ফিটের ফাঁক দিয়েই বের হয়ে গেলো। 

এভাবেই ধীরে ধীরে এগোতে থাকলাম। লা মেরিডিয়ান এর সামনে থেকে বাকি রাস্তাতেই ফুটপাত ছিলো (২/১ টা অংশ বাদ দিলে)। বাসা থেকে পানির বোতল আনি নাই। শেওড়া রেলগেটের কাছে এসে দেখলাম ছোট এক দোকানে পানির বোতল আছে। কিনে, পানি পান করে আবারও হাটা শুরু করলাম। কিছুদূর গিয়ে দেখি এক লোক আখের রস বিক্রি করছে। প্রথমে গ্লাস ধূয়ে নিলো এক প্লাষ্টিকের বালতিতে রাখা পানি দিয়ে। পানি কেমন ছিলো জিজ্ঞাসা করবেন না দয়া করে। এরপর আরেক পাত্রে রাখা অপেক্ষাকৃত পরিস্কার পানি দিয়ে ধূয়ে নিলো। মানে প্রতিবার একজন লোক আখের রস পান করার পর এভাবেই পরিস্কার করছে, মানে প্রতিবার পানি ঘোলা হচ্ছে। তারপর আমিও চোখ-কান বন্ধ করে আমিও পান করে ফেললাম। মান যাই হোক, হয়তো এই আখের রাসের কারণেই আমার এনার্জি লেভেল ঠিক ছিলো। 

লা মেরিডিয়ান থেকে প্রায় পুরোটা রাস্তায় ফুটপাত ছিলো। ব্যাতিক্রম হলো ফ্রাইওভারের ramp এর অংশগুলিতে। এসব অংশে ফুটপাত ছিলো না। Ramp আড়াআড়ি ভাবে হওয়াও ঝুকিপূর্ণ, কারণ গাড়ি আসতেছে। তবে দূপুর বলে গাড়ীর চাপ কম। মোটামুটি নিরাপদেই পার হতে পেরেছিলাম। একসময় দেখি বনানীর কাছে চলে এসেছি। অতঃপর বনানী কাকলী ওভারব্রীজ দিয়ে ওপারে গেলাম। 

ততক্ষণে দুপায়ে গোটা তিনেক ফোস্কা পড়েছে। চিন্তা করলাম খাওয়ার সময় পা দুটো একটু বিশ্রাম পাবে। তারপর হয়তো আবার হাটা যাবে। পাশেই এক হোটেলে দেখি রুটি তৈরী হচ্ছে। ঢুকে পরলাম। গরম গরম তন্দুর দিয়ে গেলো। ইচ্ছে ছিলো ডাল / ভাজি দিয়ে খাব, কিন্তু কোন ভাজি নাই। আছে গরুর মাংস, মুর্গীর মাংস, কলিজা আর মাছ। আমি অর্ডার দিলাম গরুর মাংশ। যদিও গরুর মাংসের কেজি এখন ৬৫০ টাকার কম না। মাংস আসলো। ছোট ছোট ৩/৪ টুকরা। একটা আবার হাঁড়। কোন টুকরাই ১ ইঞ্চির বড় হবে না, ছোট হওয়ার সম্ভাবনই বেশী। আর পুরুত্ব এক আঙ্গুলের অর্ধেক হবে বড়জোর। আমার সামনে এক চাচা-ভাতিজা বসছিলো। চাচার বয়স আমার চাইতে কম। ঢাকার বাইরে থেকে এসেছে। তবে তার হাঁকডাক বেশ, মনে হচ্ছিলো গ্রাম্য মাতবর শ্রেণীর। রুটি নেয়ার পর ভাজি খুজে, না পেয়ে দু’জনে একবাটি মুরগী ভাগাভাগি করে নিলো। আসলে এই শহরে টিকে থাকা অনেকের জন্যই কঠিন। এই চাচা-ভাতিজা তো তাও রুটি-মুর্গীর মাংস দিয়ে খেতে পারলো, অনেকের হয়তো খাবারই জুটে না।

খাওয়া শেষ করে বিল দিলাম ২৩৫ টাকা, বেয়ারাকে টিপস দিলাম ১০ টাকা। আমার এক বন্ধু এই টিপস দেয়া নিয়ে টিজ করে প্রায়ই, আমি নাকি বড় লোক। তাই টিপস দেই। আমি অবশ্য একদম বৃদ্ধ, অন্ধ, প্রতিবন্ধী ছাড়া ভিক্ষা দেই না। তবে হোটেলের বেয়ারাদের ৫/১০ টাকা টিপস দেই। ডেলিভারীম্যান দের আলাদা করে টিপস দেই না, তবে ১০/২০ টাকা ভাংতি ফেরত নেই না। তবে এসব কেন রি তার কোন ব্যাখ্যা নাই।

বাই দ্য ওয়ে, গরুর মাংস ছিলো ১৮০ টাকা, তন্দুর রুটি ২০ টাকা হিসেবে ৪০ টাকা আর একবোতল পানি ১৫ টাকা। সাকুল্লে ২৩৫ টাকা মাত্র। পাশের দোকান থেকে রং চা খেলাম টিব্যাগের, দাম ৮ টাকা। 

হাটতে গিয়ে বুঝলাম কষ্ট হবে। তাই আবার ওভারব্রীজ দিয়ে ওপারে গিয়ে দোতলা বাসের অপেক্ষা এবং বাস যোগে শাহবাগ। এবার প্রথমে গেলাম বাংলা একাডেমি অংশে। আগের বার এই অংশে আসা হয় নাই। কিছু বই কেনা হলো। এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি, কিন্তু সে দেখি আসে না। পরে বের হয়ে চারুকলার কাছে চলে এসেছি এমন সময় বন্ধুর ফোন। এরপর আজিজ মার্কেট, মঙ্গলাবার সাপ্তাহিক ছুটি বলে মার্কেট বন্ধ। কিন্তু সামনের দোকানগুলো সব খোলা। বন্ধু নিয়ে গেলো আরেকটু সামনে, কাঁটাবন মোর থেকে ২/৩টা বিল্ডিং পরেই দোতালায়। নাম কবিতা ক্যাফে। চা-কফি খেতে খেতে বই পড়া কিংবা কেনার ব্যবস্থা আছে। এই এলাকায় মার্কেট হলিডে বলেই কিনা জানি না, লোকজন বেশ কম ছিলো। আমাদের আরেক বন্ধু আসলো। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে চা, পিয়াজু / মুড়ি খেয়ে নয়টার দিকে বের হলাম। আবার শাহবাগ। আবার বাসে করে উত্তরা। 

বাসায় যখন ঢুকছি, তখন বাজে সাড়ে দশটার কিছু বেশী। 

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।