কোন এককালে বেতারের মহাভক্ত ছিলাম। এখনও আছি তবে আগের সেই উন্মাদনা আর নাই। আব্বা ১৯৬৮/৯ সালের দিকে একটা পকেট রেডিও এনেছিলেন বিদেশ থেকে। সেটি কবে কখন নাই হয়ে গিয়েছিলো সেটি আর মনে নাই। এরপর আবার ১৯৭৭ সালে একটি ছোট পকেট রেডিও আর একটা টু ইন ওয়ান এসেছিলো বাসায়। একসময় টু ইন ওয়ান এর ক্যাসেট অংশটি নষ্ট হয়ে যায়, তবে রেডিও ঠিক ছিলো। একসময় সেটি কিভাবে যেন আমার এখতিয়ারে চলে আসে।
রেডিও সিরিয়াসলি শোনা শুরু হয় ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকে। ছুটির দিনে বাংলাদেশ বেতারের ওয়ার্ল্ড মিউজিক এর ইয়োর চয়েস ছিলো অন্যতম আকর্ষণ। এখনও মনে হয় কান পাতলে সাদিয়া আর আনোয়ারুল এর কণ্ঠ শুনতে পাই। বাংলাদেশ বেতার (তৎকালিন রেডিও বাংলাদেশ) এর সৈনিক ভাইদের জন্য প্রচারিত অনুষ্ঠান দূর্বার আর রাত নয়টায় প্রচারিত রেডিও ম্যাগাজিন উত্তরণ ও ছিলো প্রিয়। দূর্বার এর উপস্থাপক ছিলেন হাবিবুর রহমান জালাল আর উত্তরণের উপস্থাপক ছিলেন শফি কামাল। দু’জনের ভয়েস অত্যন্ত ইউনিক ছিলো। আর ছুটির দিনগুলোতে দুপুর বেলা শুনতাম বাণিজ্যিক কার্যক্রম এর অনুষ্ঠান। সেসময় অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন হেনা কবির।
এরপর কেমন কেমন করে যেন বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা, ডয়েচে ভেলে সহ আরো নানা বিদেশী রেডিও ষ্টেশনের খোঁজ পাই। চিঠি লেখাও শুরু হয় সেসময়। বিদেশী বেতার কেন্দ্র থেকে নানা উপহার পেয়ে উৎসাহ যেন দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিলো। আশির দশকে রেডিও শোনা আর চিঠি লেখা সমান তালে চলতে থাকে। বেইলী স্কয়ারের আব্বার সরকারী বাসার এক দরজায় নানা রকম ষ্টিকার আর পেনেন্ট দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছিলাম।
আশির দশকে রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে খবরের প্রধানতম উৎস হয়ে দাঁড়ায় বিদেশী বেতার কেন্দ্রগুলো। তবে আমার সেই টু ইন রেডিও’টি তখন বয়সের ভাড়ে ন্যুজ। দূর্বল বেতার কেন্দ্র খূব একটা ধরতো না। বিভিন্ন বেতার কেন্দ্র শুনতে শুনতে ডিজিটাল রেডিও সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরী হয়েছিলো। কিন্তু বাংলাদেশে পাওয়া যায় কিনা তাই জানতাম না। মনে আছে ডয়েছে ভেলের মাসিক প্রতিযোগীতায় নিয়মিত অংশ গ্রহনকরতাম কেবল একটি ডিজিটাল রেডিও পাওয়ার আশায়। কিন্তু আমার ভাগ্যে শিকে ছিড়ে নাই।
১৯৮৯ সালে হঠাৎ করে সূযোগ আসলো সুইডেন যাওয়ার। মনে মনে ঠিক করেই ফেললাম এবার বাই হুক অর বাই কুক, একটি ডিজিটাল রেডিও আনতেই হবে। সাথে অবশ্য একটি ক্যামেরা কেনার ও গোপন ইচ্ছা ছিলো। ফেরার সময় ফিলিপস ডি-২৯৩৫ কিনে এনেছিলাম। সাথে একটি মিনোল্টা অটো ফোকাস ফিল্ম ক্যামেরা।
ঢাকায় আসার পরপরই আব্বা চাকরি থেকে অবসর নিলেন। আমরা চলে গেলাম বাবর রোড। সেখানে গিয়ে ইনভার্টেড ভি আকুতির একটি এন্টেনা দাঁড় করালাম ছাদের উপর। এরপর থেকেই বলা চলে আমার ডিএক্সইং হবি নতুন মাত্রা পেয়েছিলো। WWV, Radio Brass, KYOI ইত্যাদি দূরবর্তী রেডিও ষ্টেশন শুনতে পেরেছিলাম।
এরপর নিজের কাজকর্ম / ব্যস্ততা ইত্যাদির কারণে রেডিও শোনা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। মাঝে বহুদিন রেডিও’তে হাত দেয়া হয় নাই। হঠাৎ একদিন রেডিও হাতে নিয়ে দেখি ভিতরের ব্যাটারি গলে যাচ্ছে-তাই অবস্থা। একসময় নানারক সমস্যা দেখা দিলো। আবার অনেকদিন বাক্সবন্দি হয়ে পরে রইলো প্রিয় রেডিও। শেষবার যখন খুললাম ভিতরে পোকার বাসা, স্পিকারের কাগজ কাটা।
অনেক বছর পর আবার রেডিও’র শখ মাথাচাঁড়া দিয়েছিলো। বেশ কয়েকটি রেডিও কিনে ফেললাম। কিন্তু ততোদিনে সারা পৃথিবীতেই রেডিও গুরুত্ব অনেক কমে গেছে। বড় বড় বেতার কেন্দ্র যেমন বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা, ডয়েচে ভেলে ইত্যাদি বাজেট কমানোর অজুহাতে তাদের সম্প্রচার কমাতে কমাতে প্রায় শুণ্য করে ফেলেছে। এদিক দিয়ে অবশ্য চীন আন্তর্জাতিক বেতার কেন্দ্র ব্যতিক্রম। তারা বিভিন্ন ভাষায় এখনও সদর্পে সম্প্রচার করে যাচ্ছে।
আমি অবশ্য এখন বাংলাদেশ বেতারই বেশী শুনি। আর কিছু না শুনলেও সকালে খবর শোনা হয় প্রায় প্রতিদিন। ঢাকার বাইরে গেলে রেডিও সাথে করে নিয়ে যাই। মিডিয়াম ওয়েভ এবং এফএম ব্যান্ডে খূঁজে ফিরি দেশের এবং পার্শ্ববর্তী দেশের বেতার সম্প্রচার। আর ইন্টারনেটের বদৌলতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনা কোন ব্যাপারই না। এমনকি ঢাকায় বসে বাংলাদেশ বেতারের লো পাওয়ারের বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতে পারি অনায়াসে।
সবাই’কে বিশ্ব বেতার দিবসের শুভেচ্ছা। ভাল থাকুন নিরন্তর।
(ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব বেতার দিবস প্রতিবছর ১৩ ফেব্রুয়ারী উদযাপন করা হয়)
ফেসবুক মন্তব্য