স্কুল জীবনে আমার স্কুলের সংখ্যা ৫টি। তার মধ্যে ঢাকায় ৩টি, ময়মনসিংহে ২টি। প্রথম আর শেষ স্কুল ছিলো আমার জন্য আনন্দদায়ক। বাকি ৩টি কেন আনন্দদায়ক না, তার প্রধান কারণ শাসন। শাসন ঐ ২ স্কুলেও ছিলো, তবে বাকি ৩টির মতো গাধা পিটিয়ে মানুষ করার মতো না।
প্রথম স্কুল বটমলি হোম গার্লস হাইস্কুল। গার্লস স্কুল হলেও ছেলেরা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়তে পারতো। দিদিদের হাতে বেত থাকলেও কখনই সেটা ছাত্র-ছাত্রীদের শাসন করার জন্য ব্যবহার করা হতো না। বোর্ডে কিছু বুঝানোর সময় সেটার ব্যবহার হতো। পিট্টি দিতে হলে বড়জোর পিঠে কিল। শারীরিক শাস্তি ছিলো নিল ডাউন অথবা হাইবেঞ্চের নিচে মাথা ঢুকিয়ে দেয়া। পুরো ক্লাসের সামনে নিল ডাউন হয়ে থাকা বা হাইবেঞ্চের নিচে মাথা ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে শারীরিক কষ্ট যতোটা ছিলো তার চাইতে বেশী ছিলো লজ্জা। অনেক সময় ক্লাসের বাইরে বারান্দাতেও নিল ডাউন করতে হতো। তখন হয়তো আশেপাশের ক্লাসের ছেলে-মেয়েরাও জেনে যেতো।
আরো কিছু শাস্তি ছিলো, যেমন হোমওয়ার্ক না করলে কিংবা পড়া শিখে না আসলে স্কুল ছুটির পর সেই হোমওয়ার্ক করে দিয়ে আসতে হতো। পড়া শিখে না আসলে খাতায় হয়তো কয়েকশ বার লিখতে হতো ‘ক্লাসে পড়া শিখে আসবো’, সেটা দিদিকে দেখালে ছুটি মিলতো। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সেটা আবার বাবা-মা’কে দেখিয়ে সাইন করিয়ে আনতে হতো পরের দিন। এই শাস্তিগুলো কেবল ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ছিলো না, অভিভাবকদের জন্যও এক ধরণের শাস্তি। সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়েই কেবল দায়িত্ব শেষ না, ছেলে-মেয়ে বাসায় ঠিকমতো পড়ালেখা করছে কি না বা হোম ওয়ার্ক করছে কি না, সেটার নজরদারি করাও অভিভাবকের দায়িত্ব।
শেষ স্কুল ছিলো উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল। এ স্কুলে পড়ার সময়ও কোনদিন বেতের বাড়ি খেতে হয় নাই। নিল ডাউন বা বেঞ্চের উপর দাঁড়ানো ছিলো শাস্তি। আমাদের ঐচ্ছিক গণিত নিতেন যে স্যার উনি ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে খূবই বন্ধুসুলভ আচরণ করতেন। কিন্তু পড়ালেখার বেলায় ছিলেন দারুণ কড়া। নবম-দশম শ্রেণীে পড়ার সময় বারান্দায় লাইন ধরে নিল ডাউন করিয়ে রেখেছেন অথবা বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়েছেন – এমন ঘটনাও ছিলো। এক মেয়েকে একবার বেঞ্চের উপর দাঁড়াতে বললে সে কেঁদে-কেটে একাকার হয়েছে, কিন্তু শাস্তি মাফ হয় নাই। ছেলেদের যে ৩/৪ জন মেয়ে বলে ছেড়ে দিতে বলেছিলো, তাদেরও শেষ পর্যন্ত বেঞ্চের উপর দাঁড়াতে হয়েছিলো। আর পরীক্ষার খাতায় কোন রকম ছাড় দিতেন না। একবার বাংলা স্যার এক মেয়েকে ডাবল জিরো দিয়েছিলেন। স্যারের কথা হলো ছাত্রী প্রশ্নের উত্তর লিখতে গিয়ে আগরুম-বাগরুম লিখে খাতা ভর্তি করেছে।
এই দুই স্কুলে সেসময় আমার ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও কম ছিলো, সে কারণেই হয়তো শিক্ষকবৃন্দ ভালমতো নজর দিতে পারতেন।
বাকি ৩ স্কুলে শাস্তি বলতে ছিলো বেতের ব্যাপক ব্যবহার। মানে অনেকটা গাধা পিটিয়ে মানুষ করার মতো ব্যাপার। তবে সব শিক্ষক যে এমন ছিলেন তা না। অনেক শিক্ষক ছিলেন অসম্ভব ভালো পড়াতেন। আবার কিছু শিক্ষক ছিলেন ক্লাসে পড়াতেন যেমন-তেমন, কিন্তু শাস্তি দেয়ার বেলায় ভয়ঙ্কর। দু’জন শিক্ষককে পেয়েছি যারা বেতের পাশাপাশি চাবি কানের লতিতে চেপে ধরে ব্যথা দিতেন। এদেরই একজন আবার পক্ষপাত করতেন ব্যাপক। ক্লাসের এক ছাত্র তার কাছে প্রাইভেট পড়তো, স্যার সবসময় তার প্রশংসা করতেন। আবার আরেকজন শিক্ষক পেয়েছিলাম যার ছেলে আমাদের সাথে পড়তো, কিন্তু তিনি ছেলের বেলাতে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না।
এই ৩ স্কুলে শ্রেণী প্রতি ছাত্র সংখ্যাও ছিলো অনেক।
এই সময়ে এসে মনে হয় বেত দিয়ে আসলে গাধা পিটিয়ে মানুষ করা সম্ভব না। পড়াতে জানলে এবং সেটি আদায় করার কৌশল জানলে ছাত্র-ছাত্রী এমনিতেই পড়ালেখা করে। হয়তো কিছু ছেলে-মেয়ে থাকে যারা পড়াশোনায় একটু দূর্বল, তাদের হয়তো আলাদাভাবে খেয়াল করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে জনসংখ্যার যে চাপ, সে চাপ স্কুলগুলোতে আছে। প্রতি ক্লাসে ৫০+ ছাত্র থাকলে আসলে কারো দিকেই নজর দেয়া সম্ভব না।
ভাল থাকুন নিরন্তর।
ফেসবুক মন্তব্য