ষ্টকহোম ডায়েরী (২২)

সুইডেনে যাওয়া কনফার্ম হওয়ার পর আত্মীয়-স্বজন সুহৃদদের প্রথম কথা ছিলো আমি যেন আমার চোখ কোন ভাল ডাক্তারের কাছে দেখাই। সুইডেন যেহেতু উন্নত দেশ সুতরাং সেখানে হয়তো আমার চোখের কোন না কোন উন্নত চিকিৎসা আছেই।। আমি জন্মগতভাবে ক্ষীণ দৃষ্টি সম্পন্ন, স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই সমস্যা ধরা পরেছিলো। ডাক্তারি পরিভাষায় এ হলো congenital cataract বা জন্মগত ছানি।  বুড়ো বয়সের ছানির চাইতে এ সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস।।  সেসময় থেকেই বাবা-চাচা মিলে বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতো।  নানারকম পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর প্রায় সব ডাক্তারের সাজেশন অপারেশন করতে হবে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন ডাঃ আলিম চৌধূরী।।  তিনি বলেছিলেন জন্মগত ছানি অপারেশন করলে ভাল হতে পারে আবার নাও পারে।  মানে চান্স ৫০-৫০ ভাগ।  একজন ডাক্তার হিসেবে কখনও বলা সম্ভব না কোন রোঘী ভাল হবে, কোন রোগী ভাল হবে না।।  তিনি সাজেশন দিলেন এভাবেই চলতে থাকুক, এভাবে যদি চলতে পারে কষ্ট করে পরিনত বয়সে দেখা যাবে কি করা যায়।  হয়তো এর মধ্যে নতুন কোন টেকনোলজি চলেও আসতে পারে।  তার কথা বেদ বাক্য ধরে নিয়ে এরপর ডাক্তার দেখানোর গতি কিছুটা স্লথ হলো। তবে একেবারে বন্ধ হয়নি।  এরপর তো ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মাওলানা মান্নান আর দোসররা ডাঃ আলিম চৌধূরীকে তুলে নিয়ে যায়, তার আর খোজ পাওয়া যায়নি। 

ষ্টকহোমে যাওয়ার পর তো কয়েকমাস লেগে গেলো সব কিছুর সাথে খাপ খাওয়াতে।  কয়েকমাস পর থেকেই শুরু হলো বাসা আর দেশ থেকে ডাক্তার দেখানোর চাপ।  শেষতক সবচেয়ে কাছের সরকারী মেডিকেল সেন্টারে গিয়ে একদিন নাম রেজিষ্ট্রেশন করলাম।  কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ডাক আসলো।  আমার কাছে কোন ধরণের মেডিকেল ডকুমেন্ট ছিলো না।  তাই নতুন করে কিছু টেষ্ট করা হলো।  এরপর ডাক্তারের সাথে আলাপের পালা।  তিনি শুরুতেই জানালেন যেহেতু আমার রেসিডেন্সি নাই, তাই কোন ধরণের সরকারী সূযোগ-সূবিধা পাবো না।  আমি তখন বললাম সেটা জানি, আমি আসলে আমার চোখের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাই।  উনি হালকা পাতলা কিছু ব্রিফ করলেন।  তবে মূল কথা একটাই অপারেশন করে দেখতে হবে।  মানে দেশে যে তিমিরে ছিলাম, বিদেশে এসেও সেই তিমিরেই রয়ে গেলাম। 

উভে’কে পরদিন জানিয়েছিলামও নিজেই তখন জিজ্ঞাসা করলো প্রাইভেট কোন ডাক্তার দেখাবো কিনা।  হ্যাঁ বলতেই সে টেলিফোন গাইড ঘেটে কয়েকটা ফোন করলো।  তারপর কাগজে লিখে দিলো কখন কোথায় কয়টার সময় যেতে হবে।  আমি যথা সময়ে গিয়ে হাজির হলাম।  দেখি অসাধারণ সুন্দরী এক মেয়ে রিসেপশনে, সে আমাকে জানালো সে ডাঃ সোনিয়ার এসিট্যান্ট।  উভে আমার পক্ষ থেকে আগেই জানিয়েছিলো আমার কাছে কোন কাগজ পত্র মানে ডাক্তারি রিপোর্ট নেই।  ডাৎ সোনিয়ার এসিট্যান্ট আমাকে সরাসরি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো।  তার সাথে পরিচয় হওয়ার পর ডাক্তার হাসতে হাসতেই প্রশ্ন করলো ‘তুমি কি বলতে চাও বাংলাদেশে ভাল কোন চোখের ডাক্তার নেই ?’ আমিও হেসেই বললাম ডাক্তার হয়তো আছে, কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের জনসংখ্যা। ‘তারপর ছোট একটা ফিরিস্তি দিলাম সুইডেন আর বাংলাদেশের আয়তন আর জনসংখ্যা নিয়ে।  ডাক্তার এবার বললেন ‘আসলেই বিরাট সমস্যা। ‘ এবার সরাসরি কাজের কথা শুরু হলো।  ডাক্তার তার এসিট্যান্ট কে দেখিয়ে বললেন মেয়ে নতুন করে ইংরেজীর কোর্সে ভর্তি হয়েছে, আজ ও তোমার হিষ্ট্রি লিখবে শুনে শুনে। আমি ধীরে ধীরে জানালাম আমার রোগের ইতিহাস।  ডাক্তার আলিম চৌধূরীর কথা বললাম।  বললাম জনৈক হোমিও ডাক্তারের কথা যিনি দাবী করেছিলেন তার ঔষধ ঠিক মতো খেলে ছানি গলে যাবে।  সব শোনার পর ডাক্তার এবার কিছু রুটিন পরীক্ষা করলেন চোখের।  এরপর কথা বলা শুরু করলেন।  প্রথমেই বললেন বৃদ্ধ বয়সের ছানি আর জন্মগত ছানি এক না।  বৃদ্ধ বয়সে চোখের মনি বা লেন্স ঘোলা হয়ে যায়, সেটা ফেলে দিয়ে একটা আর্টিফিসিয়াল লেন্স বসিয়ে দিলেই ঠিক হয়ে যায়।  আর জন্মগত ছানি সাধারণত মায়ের পেটে থাকার সময়ই হয়, কোন কারণে হয়তো চোখের ফর্মেশন ঠিক ভাবে না হওয়ার কারণে। 

এপর্যায়ে তিনি হোমিও ডাক্তারের কথা বললেন – প্রথমত জন্মগত ছানি গলানোর মতো কিছু না আর দ্বিতীয়ত যে ঔষধ ছানি গলাতে পারে সেটি চোখের অন্যান্য অংশ যেমন লেন্স, চোখের উপরে যে পাতলা পর্দা থাকে সেটি যে গলাবে না তার নিশ্চয়তা কি।  আমার তখন মনে হলো আরে, তাইতো। কখনও তো এভাবে চিন্তা করে দেখি নাই। 

এরপর তিনি আসলেন ডাঃ আলিম ছোধূরীর কথায়।  বললেন – এই ভদ্রলোকের কথা এখনও তোমার জন্য প্রযোজ্য।  পার্থক্য কেবল তার সময়ে কেন কিছু রোগী ভাল হয় আর কিছু রোগী ভাল হয় না, জানা ছিলো না।  এখন আমরা ১৯৮৯ সালে এসে সেটি জানি।  যদিও প্রতিকার করার ক্ষমতা এখনও আমাদের হয়নি। 

তারপর ডাঃ সোনিয়া আমাকে বুঝিয়ে বললেন জন্মগত ছানির বেলায় আসলে কি ঘটে।  তিনি আগেই বলেছিলেন্ মায়ের পেটে থাকতেই হয়তো চোখের ফর্মেশন ঠিকমতো হয় না।  এক হতে পারে চোখের লেন্স ঠিকমতো গঠিত হয় নাই, ভিতরে হয়তো সুক্ষ একটা ভাঁজ আছে।  যার ফলে আলো ঠিকমতো রেটিনায় পরে না।  এরকম হলে জাষ্ট লেন্স ফেলে দিয়ে আর্টিফিসিয়াল লেন্স একটা বসিয়ে দিলেই হবে। রোগী চলে গেলো ভাল হওয়াদের দলে।  দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দেখা যায় আইবলের ভিতর কোন কিছু তৈরী হয়ে আছে।  আই বলের ভিতর ফাঁকা, কেবল এক ধরণের তরল থাকে।  যদি আইবলের ভিতর কোন ধরণের কোন কিছু তৈরী হয়ে থাকে তাহলে আর কিছু করার থাকে না।  মানুষ জন্মগত অনেক কিছুই ঠিক করতে পারে এখন, কিন্তু আইবল কেটে কিছু করার সক্ষমতা এখনও হয়নি।  যেদিন পারবে সেদিন কেবল জন্মগত ছানি না, জন্মান্ধ কে দেখার শক্তি দেয়ার ক্ষেত্রেও হয়তো এক ধাপ এগিয়ে যাবে। 

এরপর আরো কিছুক্ষণ কথা হলো।  জানালেন তিনি আমার বাম চোখ দিয়ে আলো ফেলে রেটিনার তেমন কিছু দেখতে পারেন নি, তবে ডান চোখেরটা কিছুটা দেখা যায়।  ঘটনা হলো আমি বাম চোখে তেমন কিছুই দেখতাম না, ঝাপসা। যা দেখার দেখতাম ডান চোখ দিয়ে কোন রকমে। 

উনি বললেন যে ডাঃ আলিম চৌধূরীর সাজেশন আমি ফলো করতে পারি এখনও।  আমি দেশে পড়ালেখা করেছি, সুইডেনে এসে কাজ করছি।  সমস্যা আছে তারপরও করতে পারছি।  তারমানে আমি চলতে পারছি।  যখন আর পারবো না, ব্যাপক সমস্যা হবে (৪০ এর পরে হওয়ার সম্ভাবনা বেশী), তখন যেন অপারেশন করার ডিসিশন নেই।  আর যদি টাকা পয়সা কিছু জমিয়ে আবার সুইডেনে আসতে পারি, তাহলে তিনি আমাকে ডিসকাউন্টে অপারেশন করার ব্যবস্থা করিয়ে দিবেন। 

সে রাতে আমার খূব কষ্ট হয়েছিলো।  নিজের জন্য না, কষ্ট হয়েছিলো ডাঃ আলিম চৌধূরীর জন্য।  আর হতভাগ্য বাংলাদেশের জন্য।  হারামজাদা পাকিস্থানিরা পরাজয়ের আগে এক অর্থে আমাদের হারিয়ে দিয়ে গেছে।  ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আমাদের সব শেষ করে দিয়ে গেছে।  প্রতিটি ক্ষেত্রেই সব আজে-বাজে লোকদের জয়জয়কার।  ডেঙ্গুজ্বর, যানজট, জ্যাম নিয়ে বোদ্ধাদের জ্ঞান দান দেখলেই সেটি বুঝা যায়। 

পূনশ্চ : ডাঃ সোনিয়ার ভাষ্যমতে চল্লিশের পর চোখের অবস্থা আসলেই মারাত্মক খারাপ হওয়া শুরু করেছিলো।  বিশেষ করে কম আলোতে, সন্ধ্যার পর বা রাতে চলতে ফিরতে তো প্রচন্ডরকমের কষ্ট হতো।  ২০১৪ সালে অবশেষে আমার ডান চোখে অপারেশন করে আর্টিফিসিয়াল লেন্স বসানো হয়েছে।  এখন অনেক ভাল দেখতে পাই।  বাম চোখে এখনও অপারেশন করা হয়নি। 

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।