ফেসবুক ষ্ট্যাটাস – ০৫

হত্যাকান্ড সংঘটনের সময় পড়তাম ক্লাস সিক্সে, বয়স ছিলো ১১/১২ বছর। সে সময় আসলেই ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো এই নির্মম হত্যাকান্ড। প্রতিদিন পত্রিকা হাতে নিয়ে প্রথমেই পড়তাম এ সংক্রান্ত খবর। বিচার শুরু হওয়ার পর সেসময় বিস্তারিত ছাপা হতো আদালতে করা সওয়াল জবাব। হত্যাকারী বহাল তবিয়তে বেঁচে বর্তে আছে এখনও, এটাই বড় ট্র্যাজেডি।

গেরিলা ১৯৭১ ফেসবুক পেজ থেকে কপি-পেষ্ট

২৭ জানুয়ারি, আজ থেকে ঠিক ৪৩ বছর আগে সেদিন মঙ্গলবার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্রী নীহার বানু জানতেন না কি ঘোর অমঙ্গল নিয়ে দিনটি এসেছে তাঁর জীবনে।
 
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে অরাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর ভেতর সবচেয়ে আলোড়িত-আলোচিত ও নৃশংস ঘটনা ছিল ১৯৭৬ সালে নীহার বানু হত্যাকাণ্ড।
 
অনিন্দ্য সুন্দর এ মানুষটির বাবা শহীদ নাজিবুর রহমান ছিলেন একাত্তরের অগণিত শহীদদের একজন। স্বাধীন দেশের আরও বহু পরিবারের মতোই যুদ্ধের পরবর্তী যুদ্ধ ও দহনের ভেতর দিয়ে আশাবাদী ভবিষ্যতের দিকে চলছিলেন নীহার বানুর পরিবার। তাঁর পুরো পরিবার নির্ভরশীল ছিল ডাক্তার বড় বোনের (ডাঃ মঞ্জিলা বেগম) উপার্জনের ওপর।
শীতের সেই বিকেলে নীহার বানু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস থেকে নেমে বাড়ি হেঁটে আসেননি। তাঁকে আর কোনদিনই কোন মানুষ বাড়ি ফিরতে দেখেননি।
 
সন্ধ্যের পর তাঁর বড় বোন ডাঃ মঞ্জিলা ফিরে এলে, উৎকণ্ঠিত মা জানালেন নীহারের ফিরে না আসার ঘটনা। হাসপাতাল, থানা থেকে শুরু করে সম্ভাব্য সবগুলো স্থানেই খোঁজ এবং একাত্তরের পর আবারও আরেকটি দীর্ঘ নিকষ কালো রাত পেরিয়ে ভোরের সূর্যের অপেক্ষায় কাটালেন তাঁরা। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ক্লাসমেট, শিক্ষক সবাই জানলেন নীহার বানু বাড়ি ফেরেননি। এবং নিশ্চিত করলেন আগের দিন তাঁর ক্লাসে উপস্থিতি।
 
নীহার বানু নিখোঁজের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আহমেদ হোসেন বাবু এবং তার বন্ধু মিন্টূ। নীহার বানুর পরিবারের পরিচিত মুখ ছিল মিন্টূ। নীহার বানুর অন্তর্ধানের পর থেকে মিন্টূর আচরণে পরিবর্তনের বিষয়টি তাঁর পরিবারের সদস্যরা লক্ষ্য করেন। বিষয়টি পুলিশকেও জানান তাঁরা।
 
একটি ক্ষত ও রহস্য উন্মোচনঃ
★★★★★★★★★★★★★★★
কিন্তু কোন অকাট্য তথ্য ও প্রমাণ তখনো পুলিশের হাতে নেই। আহমেদ হোসেন বাবু, মিন্টূ’র প্রতি পুলিশের নজরদারির কালে হাতে কখনো রুমাল অথবা ব্যান্ডেজ নিয়ে ঘুরছিল সেতু নামে তাদের আরেক বন্ধু। পুলিশের নজরদারিতে সেও ছিল।
পুলিশ পিছু নিলেও ঘুণাক্ষরে কখনো টের পায়নি সেতু। এক বিকালে সেতু রাজশাহী শহরের এক চিকিৎসকের চেম্বারে যায়,বাইরে তার অজ্ঞাতে দাঁড়িয়ে থাকে অনুসরণকারী পুলিশ। ঘণ্টাখানেক পর বেরিয়ে আসে হাতে নতুন ব্যান্ডেজ নিয়ে। সেতুকে অনুসরণকারী পুলিশের কর্মকর্তা সেই চিকিৎসকের কাছে জানতে চান সেতু সম্পর্কে।
 
সেই চিকিৎসক জানালেন, যে যুবক এসেছিল, তার বাঁ হাতে বড় একটি ক্ষত রয়েছে। যুবকটি তাকে কুকুরে কামড়েছে বলে জানালেও তিনি সন্দেহ করছেন এটি সম্ভবত মানুষের কামড়ের দাগ। পুলিশ কর্মকর্তা দ্রুত বেরিয়ে পড়লেন। বেশ ক’দিন সেতুর পেছনে ঘুরতে ঘুরতে সেতু’র সব আস্তানাই চেনা হয়ে গেছে।
 
এবার অপেক্ষায় রইলেন তিনি পুরো ফোর্স নিয়ে। সেতু বের হবার সাথে সাথেই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। সাথে প্রশ্ন ‘তার হাতের ক্ষত কীসের’? প্রশ্নে ঘাবড়ে যায় সেতু। যদিও পুলিশ কিন্তু তখনও নিশ্চিত নয়। সেতুর হাতের সেই ক্ষত’কে কেন্দ্র করেই পুলিশ এগুচ্ছে নীহার বানু অন্তর্ধানের রহস্য উন্মোচনের পানে।
 
পুলিশী জেরার মুখে একপর্যায়ে সেতুর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে রোমহর্ষক নৃশংস এক বিবরণ। নীহার বানু নিরুদ্দেশ অথবা বেঁচে আছেন এমন ক্ষীণ আশার চির সমাপ্তি ঘটে সেতু’র জবানবন্দী থেকে।
 
২৭ জানুয়ারি ১৯৭৬ সাল,মঙ্গলবার গোধূলির লগ্নে অপার সম্ভাবনাময় মানুষ নীহার বানুকে হত্যা করা হয়েছিল নির্মম নির্যাতনের পর। হত্যার পর তাঁর মৃতদেহ ট্রাঙ্কের ভেতর রেখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটবর্তী ‘মীনা মঞ্জিলে’র ভেতর মাটি খুঁড়ে চাপা দেয়া হয়। পরবর্তীতে সেই মেঝে সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করা হয়েছিল।
 
হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ও পরিকল্পনাকারী আহমেদ হোসেন বাবু তার বন্ধু মিন্টূ,সেতু সহ আরও ২/৩ জন মিলে ‘মীনা মঞ্জিলে’ হত্যা করে নীহার বানুকে। কারণ নীহার বানু, তাঁর খুনি সহপাঠী আহমেদ হোসেন বাবু’র একতরফা প্রেমের আহবানে সাড়া দেননি।
বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টায়, মনুষ্যরুপী পশুদের প্রতিরোধের ব্যর্থ চেষ্টার মুহূর্তে খুনি সেতুর হাতে কামড় দেয়ার সেই চিহ্নটি তাঁর মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায়। হত্যার প্রায় ৬ মাস পর রাজশাহী শহরের উপকণ্ঠের মীনা মঞ্জিলের মেঝে খুঁড়ে ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় নীহার বানু’র কঙ্কাল। সে মুহূর্তে তাঁর পরনে একটি চমৎকার নকশী পুলওভার ছিল। সেই পুলওভার পরিহিত ছবিটি আজও আছে একজন ‘নির্বাসিত নীহার বানু’র চিহ্ন হিসেবে। তুলনাহীন জীবনের সুগন্ধ পৃথিবীকে দেবার সুযোগ পাননি তিনি।
 
একাত্তরে পিতাকে হারাবার পাঁচ বছরের মাথায় তাঁকেও চলে যেতে হয়েছিল পিতার কাছেই। কি হৃদয় বিদারক যন্ত্রণা, তাঁদের দুজনকেই বর্বর পশুদের হাতে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
 
বিচার পর্ব ও পলাতক খুনিদ্বয়ঃ
★★★★★★★★★★★★★★★
১৯৭৭ সালে দেশে তখন সামরিক শাসন চলছে। বগুড়ায় স্থাপিত দেশের উত্তরাঞ্চলের বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার (?) হয়েছিল দেশ কাঁপানো ‘নীহার বানু’ হত্যাকাণ্ডের। মূল আসামি আহমেদ হোসেন বাবু সহ দুই নরপশুর অনুপস্থিতিতে বিচার সম্পন্ন হয়েছিল। পলাতক দু’জনসহ মোট তিন আসামিকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়, আরেকজনকে দেয়া হয়েছিল কয়েক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
 
কিছু কথাঃ
★★★★★★
বছরখানেক আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বিচিত্রা’, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে অসাধারণ সব প্রতিবেদন প্রকাশ করে পাঠক হৃদয়ে স্থায়ী আসন লাভ করেছে। ১৯৭৬ সালে সংঘটিত এই হৃদয় বিদারক হত্যাকাণ্ডের ওপর বিচিত্রার তৎকালীন রাজশাহী প্রতিবেদক আহমেদ শফিউদ্দিন বিস্তারিত লিখেছিলেন। সেই প্রতিবেদন সমগ্র বাংলাদেশকে আক্ষরিক অর্থে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। রাজশাহী শহরে খুনিদের ছবিসহ পোস্টার সাঁটানো হয়েছিল।
 
এবং বছরখানেক পর এই হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত তথ্য নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, ‘নির্বাসিতা নীহার বানু’ নামে।
 
আমরা কি করতে পারি?
★★★★★★★★★★★★
গত প্রায় এক দশক ধরে সীমিত সাধ্য ও ক্ষমতায় এই হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি আহমেদ হোসেন বাবু’র বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত তাঁর সম্পর্কে কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি শুধুমাত্র তাঁর সম্ভাব্য অবস্থান জার্মানি ব্যতীত।
এই নরপিশাচের স্পষ্ট অথবা সাম্প্রতিক কোন ছবি আমরা সংগ্রহ করতে পারিনি। তবে সন্দেহ নেই, এ বর্বর খুনির অতীত সম্পর্কে অবশ্যই তার বর্তমানের কেউ না কেউ জানে।
 
স্বদেশ ও বিদেশের সকল সুহৃদদের প্রতি আকুল আবেদন থাকবে, যদি এই পলাতক খুনি’কে আপনি চিনে থাকেন অথবা তাঁর অবস্থান জানা থাকে তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানান। যে দেশে অবস্থান করছে সেখানের দূতাবাসে তথ্যটি দিন। নিশ্চিত করুন ৪৩ বছর আগে সংঘটিত ‘নীহার বানু’ হত্যাকাণ্ডের বিচার।

ফেসবুক মন্তব্য

রিফাত জামিল ইউসুফজাই

জাতিতে বাঙ্গালী, তবে পূর্ব পূরুষরা নাকি এসেছিলো আফগানিস্তান থেকে - পাঠান ওসমান খানের নেতৃত্বে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। লড়াই এ ওসমান খান নিহত এবং তার বাহিনী পরাজিত ও পর্যূদস্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে টাঙ্গাইলের ২২ গ্রামে। একসময় কালিহাতি উপজেলার চারাণ গ্রামে থিতু হয় তাদেরই কোন একজন। এখন আমি থাকি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কোন এককালে শখ ছিলো শর্টওয়েভ রেডিও শোনা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে একমাত্র কাজ ছিলো একটি ডিজিটাল রেডিও কেনা। ১৯৯০ সালে ষ্টকহোমে কেনা সেই ফিলিপস ডি ২৯৩৫ রেডিও এখনও আছে। দিন-রাত রেডিও শুনে রিসেপশন রিপোর্ট পাঠানো আর QSL কার্ড সংগ্রহ করা - নেশার মতো ছিলো সেসময়। আস্তে আস্তে সেই শখ থিতু হয়ে আসে। জায়গা নেয় ছবি তোলা। এখনও শিখছি এবং তুলছি নানা রকম ছবি। কয়েক মাস ধরে শখ হয়েছে ক্র্যাফটিং এর। মূলত গয়না এবং নানা রকম কার্ড তৈরী, সাথে এক-আধটু স্ক্র্যাপবুকিং। সাথে মাঝে মধ্যে ব্লগ লেখা আর জাবর কাটা। এই নিয়েই চলছে জীবন বেশ।